চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। এই আয়ের মূল অংশটিই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের অবদান ২০ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানির ৮৩ শতাংশ। এ পর্যন্ত সব ঠিক থাকলেও শনিবার জাতিসংঘের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) এক ঘোষণায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে এই খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার ধারাবাহিকতায় তৈরি পোশাকশিল্পের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এরই মধ্যে জল্পনা শুরু হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো বলছে, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেলে জিএসপি সুবিধা হারাবে দেশের পোশাক খাত, এ ক্ষেত্রে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিজিএমইএ নেতারা।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এরপর আরো তিন বছর বর্তমানের জিএসপি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। এই সুযোগ ২০২৭ সালের পর আর থাকবে না। তবে এখন থেকে পদক্ষেপ নিলে ২০২৭ সালের পর জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে পারে বলে রবিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এ সময় মন্ত্রী সরকারের তরফ থেকে জিএসপি প্লাস প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দিলেও ভারতকে এই সুবিধা দেয়নি।
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পরে বাংলাদেশের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিশ্ববাজারে রপ্তানির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো। কারণ বিভিন্ন দেশে এলডিসি হিসেবে যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে, তা আর থাকবে না। বাংলাদেশ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করলেও তৈরি পোশাক খাত থেকে মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগের বেশি আসে। আর পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বাংলাদেশ অগ্রাধিকারমূলক বাজার প্রবেশাধিকার সুবিধা পায়। বর্তমানে দেশের তৈরি পোশাক ইউরোপীয় ইউনিয়ন, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, রাশিয়ার মতো প্রায় ৪০টি দেশে জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) সুবিধা পায়। এই সুবিধা ক্ষেত্র বিশেষে বিনা শুল্ক থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত কম শুল্কে পণ্য রপ্তানির সুযোগ পায়; কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের তকমা পেয়ে গেলে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে তৈরি পোশাক খাত।
একই সঙ্গে এলডিসি উত্তরণ পর্যায়ে এবং পরবর্তী সময়ে রপ্তানি আয় বাড়াতে পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণের বিকল্প নেই। আগামী ১০ বছর বহুমুখীকরণের উদ্যোগ জোরদার করা সরকারের অন্যতম কাজ হওয়া উচিত বলে মনে করেন ব্যবসায়ী নেতারা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং বিজিএমইএ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৭ সালে শুধু ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। টাকার হিসাবে রপ্তানির পরিমাণ ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা (ডলারপ্রতি ৮৪ টাকা হিসাবে) রপ্তানি হয়েছে ইউরোপের ২৭টি দেশে। রপ্তানি হওয়া পোশাকের ৬৪ শতাংশই গেছে ইউরোপিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে। ইইউতে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিনা শুল্কে রপ্তানির সুবিধা পায়; কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেলে এই সুবিধা আর থাকবে না।
তবে পোশাক খাতের সম্ভাব্য প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারি পর্যায়ে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিজিএমইএর সহসভাপতি (ফিন্যান্স) মোহাম্মদ নাছির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের প্রধান বাজার ইউরোপ। উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেলে নিশ্চিতভাবে দেশ হিসেবে আমাদের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে বাড়বে; কিন্তু একই সঙ্গে অগ্রাধিকার সুযোগগুলো হারাব। এই কারণে ইউরোপের বাজারে জিএসপি-প্লাস সুবিধা পেতে এখনই সরকারি পর্যায়ে দেন-দরবার চালাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই; কিন্তু শুল্ক দিয়ে প্রবেশ করতে গেলে আমাদের জন্য বাজার সংকুচিত হয়ে যাবে।’
বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি এবং ইস্টার্ন অ্যাপারেলস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা আসবে ব্যবসা করার জন্য। এখন ডিউটি ফ্রি সুবিধার কারণে বাংলাদেশ থেকে কম দামে বিশ্বমানের পণ্য নিতে পারছে তারা; কিন্তু জিএসপি সুবিধা হারালে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকার তালিকায় আমরা থাকব না। তাই যেভাবে হোক জিএসপি-প্লাস সুবিধাটা আমাদের আদায় করতেই হবে।’
তবে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক পণ্যের আধিপত্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করেন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি আবু তৈয়ব। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জিএসপি অনেক ক্ষেত্রেই দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। সে ক্ষেত্রে উন্নয়ন মান সূচকে দেশের অবস্থান খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। এ কারণে রপ্তানিতে কতটুকু প্রভাব ফেলবে এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না।’
এ ক্ষেত্রে দেশের গার্মেন্ট কারখানাগুলোর কমপ্লায়েন্সড হওয়াকে বড় ঢাল হিসেবেই দেখছেন তিনি। দেশের ৯০ শতাংশ কারখানা এরই মধ্যে কমপ্লায়েন্স স্বীকৃতি পাওয়ার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘আমাদের কারখানাগুলোর পরিবেশ, সক্ষমতা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এখানে বিশ্বের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো কাজ করে। তারা শুধু সস্তা বিবেচনায় বাংলাদেশে আসেনি। বরং আমাদের কাজের মান, দক্ষতা, উৎপাদন ক্ষমতা, কারখানায় কাজের পরিবেশ সব বিবেচনায় দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সঙ্গে কাজ করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। বড় ব্র্যান্ডগুলো হুট করে কারখানা পরিবর্তন করে না, কারণ তারা পোশাকের মান নিয়ে ঝুঁকি নিতে পছন্দ করে না। আর দেশের সূচক পরিবর্তনের এই সময়ে এটাই আমাদের সবচেয়ে প্লাস পয়েন্ট।’