রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরবর্তী সময়ে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বেশ অগ্রগতি হলেও এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এখনও ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করে ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থটি বলছে, এ সময়ে নেওয়া উদ্যোগের ৩৯ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে, ৪১ শতাংশ চলমান রয়েছে, কিন্তু ২০ শতাংশ উদ্যোগের বাস্তবায়ন একেবারেই মন্থর। মালিকপক্ষ ব্যবসা টিকিয়ে রাখা ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে প্রাধান্য দিচ্ছে কিন্তু শ্রমিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যাপ্ত গুরুত্ব পাচ্ছে না।
দুর্ঘটনার পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে টিআইবির ‘তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন : অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। এতে তৈরি পোশাক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীভূত তদারকি ও সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদে একক কর্তৃপক্ষ গঠন করাসহ আট দফা সুপারিশ তুলে ধরে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। টিআইবির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক মো. ওয়াহিদ আলম এতে উপস্থিত ছিলেন। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা।
সংবাদ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, রপ্তানি বৃদ্ধি ও ব্যবসা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে মালিক পক্ষ অনেক কিছুই করছে। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় তারা তেমন কিছুই করছে না। মালিকপক্ষের শ্রমিক অধিকারসুলভ মানসিকতার অভাবেই খাতটিতে এখনও সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু শ্রমঘন এখাতে মালিকদের পাশাপাশি শ্রমিকদেরও ব্যাপক স্বার্থ রয়েছে, তাই উভয়পক্ষকেই তৈরি পোশাক খাতের ওপর সুনজর দিতে হবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ খাতের অর্জিত অগ্রগতির বাস্তব সুফল থেকে শ্রমিকরা এখনও বঞ্চিত। শ্রম আইনে শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়া হলেও নিবন্ধনপ্রাপ্ত শ্রমিক ইউনিয়ন শ্রমিকদের অধিকার কতটুকু রক্ষা করতে পারছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বরং মালিক পক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকা শ্রমিক ইউনিয়নগুলোই প্রাধান্য বিস্তার করছে। আবার সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশকিছু অবকাঠামোগত উন্নতি হলেও সেখানে প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে।
এ সময় রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের এখনও যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি দাবি করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে সরকার, মালিকপক্ষ এবং ক্রেতাদের ব্যর্থতা রয়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হলে অবশ্যই তৈরি পোশাক খাতের উন্নয়ন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৭ সালের মে থেকে ২০১৮ সালের মার্চের মধ্যে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার পরবর্তী পাঁচ বছরে সমন্বিত নানা উদ্যোগে নিরাপত্তা, তদারকি, মজুরি, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি লক্ষণীয়। তবে, শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে আইনি সীমাবদ্ধতা এবং যৌথ দরকষাকষির পরিবেশ সৃষ্টিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতির পাশাপাশি মালিক পক্ষের প্রভাব এখনও অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে শ্রমিকের চাকরিচ্যুতিতে ক্ষতিপূরণ, দুর্ঘটনার পর পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, সংগঠন করার অধিকার, মারাত্মক অসুস্থতার জন্য সামাজিক নিরাপত্তাসহ অনেক বিষয়ে প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন করা অধিকাংশ কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলেও জাতীয় উদ্যোগের কারখানাগুলোয় কোনো অগ্রগতি হয়নি। নতুন দুর্ঘটনা সংঘটিত হলে এ খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের ঝুঁকি রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক খাতের সংস্কারে লক্ষ্যে নেওয়া সমন্বিত ১০২টি উদ্যোগের মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে ৪০, এখনও চলমান রয়েছে ৪২টি, তবে বাকি ২০ উদ্যোগের কাজ চলছে খুবই ধীরগতিতে।
পোশাক খাতের বিভিন্ন দুর্ঘটনার মামলায় শুনানির তারিখ পরিবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টির অভিযোগ তুলে বলা হয়েছে রানা প্লাজা, তাজরিন ফ্যাশন এবং স্পেকট্রাম ফ্যাশন গার্মেন্ট সংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। ১৪৭টি বিশেষজ্ঞ কারখানা পরিদর্শকের পদ এখনও শূন্য রয়েছে। উঁচু ভবনগুলোর অগ্নি নির্বাপণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্র-সামগ্রির ঘাটতি থাকায় অগ্নি নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্মুখিন হচ্ছে। শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির তালিকায় ২৬টি প্রতিষ্ঠানই তৈরি পোশাক খাতভুক্ত নিয়োজিত।
সরকার ও ক্রেতাদের উদ্যোগ সত্ত্বেও ৩২ শতাংশ পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্যোগের আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, আর্থিক সংকট, ভাড়া করা ভবনে কারখানা স্থাপন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা প্রভৃতি কারণে বিভিন্ন কারখানার সংস্কার কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারখানা সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকার ও ক্রেতাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন কারণে প্রায় ১ হাজার ২০০ পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফলে প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। এছাড়াও, আরসিসির সক্ষমতা নিরূপণের জন্য সমন্বিত পরিবীক্ষণ ব্যবস্থায় মালিকপক্ষের সংযুক্তিকরণ এবং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ না রাখার ফলে মালিক পক্ষের অনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ঝুঁকি রয়েছে।
গবেষণায় অধিকাংশ ছোট ও সাবকন্ট্রাক্ট কারখানাগুলোতে ন্যূনতম মজুরি প্রদান না করা, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির পর উৎপাদনের অতিরিক্ত টার্গেট নির্ধারণ, নিয়ম বহির্ভূতভাবে মজুরি কর্তন, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৪ ঘণ্টা করা, অনেক ক্ষেত্রে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার অতিরিক্ত কর্মঘণ্টায় শ্রমিকদের কাজ করানো ইত্যাদি অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে পোশাক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীভূত তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদে একক কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবি জানিয়েছে টিআইবি। এর পাশাপাশি ন্যূনতম মজুরি ও সংগঠন করার অধিকার, আইনে প্রাপ্য শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সমন্বিত উদ্যোগ, সাব-কন্ট্রাক্ট ও ক্ষুদ্র কারখানার কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে বিভিন্ন অংশীজনের অংশগ্রহণে একটি তহবিল গঠন, বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মামলার দ্রুত বিচার এবং শ্রম আদালতগুলোকে ট্রাইব্যুনালে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে মামলায় গতি আনার দাবি জানানো হয়।