Home Bangla Recent পাঁচ বছরেও ঝুঁকিমুক্ত হয়নি পোশাক খাত

পাঁচ বছরেও ঝুঁকিমুক্ত হয়নি পোশাক খাত

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পাঁচ বছর

বিশ্বে পোশাক খাতের ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসের পাঁচ বছর পরও ঝুঁকিমুক্ত হয়নি বাংলাদেশের পোশাক খাত। ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় সে সময় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৪ জন মানুষ, আর আহত হন আড়াই হাজারের বেশি। রানা প্লাজার দুর্ঘটনাটি আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও বিক্রেতাদের জন্য ছিল বড় একটি শিক্ষা। এতেকরে গোটা পোশাক খাতে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনার চিত্র বদলে যাওয়ার কথা। কিন্তু তেমনটি হয়নি। ক্রেতাদের চাপে দুই বিদেশি ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে বেশ কিছু কাজ করেছে। কিন্তু সরকার ও পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এক্ষেত্রে খুব বেশি উদ্যোগ নেয়নি বলে শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করেন। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এখনো ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হচ্ছে না। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়নি। মালিকদের অবহেলায় শ্রমিকদের মৃত্যু হলে সে জন্য শাস্তির বিধানও পরিবর্তন করা হয়নি। সর্বোপরি বড় পোশাক কারখানাগুলোর পরিবেশ উন্নত হলেও ছোট কারখানা এবং সাব-কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে যেসব কারখানায় কাজ হচ্ছে— সেখানকার পরিবেশ এখনো ঝুঁকিমুক্ত হয়নি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মিরপুর রূপনগর আবাসিক এলাকার ২৭ নম্বর রোডের একেবারে শেষ মাথায় একটি আধাপাকা ঘরে ২০-২৫ জন পোশাক শ্রমিক ছেলেদের টি-শার্ট তৈরি করছেন। খালের পাশের অবস্থিত টিনশেডের ঘরটি মূলত একটি পোশাক কারখানা। এটি সাব কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে কাজ করে। গতকাল দুপুরে কারখানাটিতে গিয়ে দেখা গেছে, চারদিকে তৈরি করা পোশাকের স্তূপ। এসব পোশাক মেশিন ঘরটির উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে রেখেছে। এ জন্য শ্রমিকরা গাদাগাদি করে কোনোরকমে কাজ করছেন। সেই শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেরই বয়স ১৮-এর নিচে, অর্থাৎ তারা শিশু শ্রমিক। ঘরটিতে নেই পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা। আর ঘরের বাইরে পাশের ডোবা থেকে আসছিল দুর্গন্ধ ও মশার দল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগে কারখানাটির মালিক বিদেশে পোশাক রপ্তানি করলেও এখন স্থানীয় বাজারেই তিনি পোশাক বিক্রি করেন। এ কারখানাটির মতো রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আরও অসংখ্য কারাখানা সাব কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে কাজ করছে। যেখানে সুষ্ঠু কর্মপরিবেশের কোনো মানদণ্ডই মানা হচ্ছে না। গত পাঁচ বছরে দেশের বড় কারখানাগুলো, যাদের সঙ্গে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে— তাদের কর্মপরিবেশ অনেকাংশে নিরাপদ হয়েছে। কিন্তু ছোট কারখানা বিশেষ করে সাব কন্ট্রাক্ট চুক্তিতে যেসব কারখানা আরেকটি ভবনে কাজ করছে— তাদের পরিবেশ বদলায়নি। বাংলাদেশ সরকার এসব কারখানার মান উন্নয়নে দায়বদ্ধ। পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ উন্নত করার জন্য পাঁচ বছরের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সও।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতনতা অবলম্বন করছেন। আবার পোশাক মালিকরাও শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নত করার ক্ষেত্রে সচেতন হয়ে ওঠেছেন। এমনকি বিদেশি ক্রেতারা কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবে না— এমন কারখানা থেকে পোশাক ক্রয়ের ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ২০১৩ সালের আগে বছরে পোশাক খাতে সৃষ্ট দুর্ঘটনায় যেখানে গড়ে ২০০ শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটত, বর্তমানে তা অনেকাংশে কমে এসেছে। দুর্ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত ৪০ জন শ্রমিকের প্রাণ যায়। আর সেটিও অগ্নি দুর্ঘটনায়। তবে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশের পোশাক কারখানার নিরাপত্তায় বেশ গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু গবেষক, বিভিন্ন রিটেইল এলায়েন্স এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কর্মকর্তারা মনে করেন, এ খাতের নিরাপত্তার জন্য আরও অনেক কাজ করতে হবে। দুর্ঘটনার পর এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬০০টি কারখানা ঘুরে ৯৭ হাজার ত্রুটি পেয়েছে ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড। ত্রুটির মধ্যে পাওয়া গেছে— বৈদ্যুতিক ও কারখানার অবকাঠামোগত ত্রুটি, ভবনে অগ্নি দুর্ঘটনার সময় বিকল্প বহির্গমন পথ না থাকা। অ্যাকর্ড এ সময় প্রায় ২৫ লাখ শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। এ সময় প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৬২১টি কারখানা ঘুরে এক লাখ ৩১ হাজার ৯৫৩টি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অগ্নি, অবকাঠামোগত এবং বৈদ্যুতিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়— এমন সমস্যা চিহ্নিত করে। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে ৯৭ হাজার ২৩৫টি সমস্যার সমাধান করা হয়। গড়ে প্রতি কারখানায় ৬০টি ত্রুটি ঠিক করা হয়। আর নিরাপত্তার মান নিশ্চিত না করায় ৯৬টি কারখানার সঙ্গে তারা সম্পর্ক ছিন্ন করে। এতে এই কারখানাগুলো অ্যাকর্ডের সঙ্গে যুক্ত ইউরোপীয় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আর পোশাক বিক্রি করতে পারবে না।

সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানান, গত পাঁচ বছরে কারখানাগুলোর ৮৫ শতাংশরই সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। আর ত্রুটি থাকায় ৫০টি কারখানা ভবন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ১০৯টি কারখানা, যেগুলো কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করার ক্ষেত্রে কোনো সহযোগিতা করেনি— তাদের চুক্তিপত্র বাতিল করা হয়েছে। ফলে তারা অ্যাকর্ডে থাকা বড় বিদেশি গ্রুপগুলোর সঙ্গে আর ব্যবসা করতে পারবে না। চুক্তি বাতিলের ১৮ মাস পর তারা যদি কাজের মান উন্নয়ন করতে পারে, তবে তাদের নতুন করে চুক্তি করার সুযোগ দেওয়া হবে। শুরুতে অ্যাকর্ড ৯৬৯টি কারখানার সার্কিট সমস্যা বা বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখতে পায়। যা অগ্নি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। চলতি বছরের মার্চ মাসে ৮২.৮ শতাংশ কারখানায় এই সমস্যা ঠিক করা হয়। আবার ২০১৩ সালে যেখানে ৯৭ শতাংশ কারখানার কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকার সমস্যাটি ছিল। কিন্তু এই মার্চে ৯৬.৫ শতাংশ কারখানায় বিষয়টি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। এ ছাড়া ৮৪৬টি কারখানার কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে অ্যাকর্ড।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৮২৩টি কারখানা অগ্নিনির্বাপণ ও সাইরেনের ব্যবস্থা নেই। আর ২৮৬টি কারখানার ভবন অবকাঠামোগত (লোড ম্যানেজমেন্ট) সমস্যা আছে। মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৩৬ হাজার ২৪১টি অগ্নি নিরাপত্তা, ৫৭ হাজার ৯০৬টি বৈদ্যুতিক সমস্যা, ১৪ হাজার ৮৪১টি অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধান করে। এর মধ্যে কিছু কাজ ছিল ইতিবাচক। যেমন অ্যাকর্ডের আওতাধীন ৯৭ শতাংশ তালা লাগানো কলাপসিবল গেট সরানো হয়। ৮২ শতাংশ কারখানায় ত্রুটিবিহীন বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার শুরু হয়।

উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটির নজরদারিতে থাকা ৬৬৬টি কারখানার অর্ধেকের সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। বাকিগুলোর অর্ধেক সমস্যা সমাধান হয়েছে। অ্যালায়েন্সের উদ্যোগে কারখানার ভিতর কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর জন্য শ্রমিকদের ২৪ ঘণ্টাব্যাপী হেল্প লাইন খোলা হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে সে হেল্প লাইনে ছয় হাজারের মতো ফোন কল পাওয়া যাচ্ছে।

তবে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নস করতে বাধা দেওয়া হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপে কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়ার বিষয়টি বিগত বছরগুলোতে গুরুত্ব পায়। বর্তমানে দেশে ৪৪৫টি কারখানার ২ লাখ ১৬ হাজার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ পাচ্ছেন। আবার সাব কন্ট্রাক্ট চুক্তিতে বাণিজ্যিক ভবনে কারখানার সংখ্যাও কমে এসেছে। গত চার বছরে ১৫৫ থেকে এই সংখ্যা ৭৯-তে নেমে এসেছে। ঢাকা থেকে সরে এসব কারখানা গাজীপুরের শিল্প এলাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে।

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজ্জেকুজ্জামান রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিকরা কতটা অনিরাপদ— তা রানা প্লাজার দুর্ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পরও আইনগত সহায়তা, ট্রেড ইউনিয়ন করার সুবিধা, ঝুঁকিতে পড়লে পুনর্বাসন সুবিধা পাওয়ার বিষয়গুলো নিশ্চিত হয়নি। বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গত পাঁচ বছরে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত, নিহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের মাঝে ২৮০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। দেশের পোশাক খাতের পরিবেশ এখন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় নিরাপদ। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন তৈরি পোশাক খাতে নিরাপত্তার রোলমডেল। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আমরা অনেকগুলো সংস্কার কাজ করেছি। বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের কারখানাগুলো নিরাপদ ও স্বচ্ছতা বজায় রাখছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here