তৈরি পোশাক শিল্প ও বস্ত্র খাত চলছে বছরভিত্তিক রাজস্ব নীতির আলোকে। এটিকে উন্নয়নের বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করে খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নে উদ্যোক্তাদের প্রস্তুতি গ্রহণ ও সক্ষমতা অর্জনে দীর্ঘমেয়াদি রাজস্বনীতির বিকল্প নেই। রফতানি আয়ের চাকা সচল রাখতে সরকারকে স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব কৌশল থেকে সরে আসতে হবে। শিল্প সহায়ক দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে নজর দিলে উভয় কূলই রক্ষা হবে।
প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে তৈরি পোশাক খাত ও এর পশ্চাৎপদ শিল্পের জন্য ৫ বছর মেয়াদি রাজস্ব নীতি প্রণয়নের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নির্দিষ্ট হারে শুল্ক, কর ও মূসক স্তর নির্ধারণের তাগিদ দিচ্ছেন। এ ছাড়া তৈরি পোশাকের সঙ্গে এর উপকরণ সরবরাহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতেরও কর্পোরেট করহার হ্রাস, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া এবং রফতানির উৎসে কর তুলে দেয়ার পক্ষে তারা। রাজস্বনীতিতে যে দ্বৈতনীতি রয়েছে তারও সুরাহা চাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
বাজেট সামনে রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিএমএরের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। সেখানে সংশ্লিষ্টরা তাগিদ দিয়েছে যে, প্রস্তাবিত বাজেট যেন হয় দেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রাক-প্রস্তুতিমূলক এবং ব্যবসা-বিনিয়োগ-উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বান্ধব। তারা রাজস্বনীতিতে ঘনঘন পরিবর্তনের বিপক্ষে মত দিয়েছেন প্রস্তাবে। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতার ফলে বস্ত্র ও পোশাক খাত যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যখন-তখন গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সরাসরি প্রভাব পড়ছে উৎপাদনে। এখান থেকে বের হয়ে আসার যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজেট এলেই রাজস্ব খাতের সম্ভাব্য সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস হয়। এর মাধ্যমে রাজস্বের বিভিন্ন উপখাত মূসক, কর ও শুল্ক কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন আসে। সরকারের স্বল্পমেয়াদি অনেক পদক্ষেপের কারণে উদ্যোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। বেড়ে যায় ব্যবসার খরচও। তাছাড়া আগামী বাজেট এমন একটি সময়ে দেয়া হচ্ছে যখন দেশে একটি জাতীয় নির্বাচন আসছে। এমনিতেই বিশ্ব পরিস্থিতি একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পোশাক খাত সংস্কারের নামে বিদেশি ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের ব্যয়বহুল ফর্মুলা বাস্তবায়নের বাড়তি চাপ। এসব কারণে ব্যবসায় তারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারছেন না। কারখানার সম্প্রসারণ উদ্যোগও আটকে আছে। কমে গেছে নতুন বিনিয়োগ আনার হার। রফতানি আয়ে চলছে মন্থর দশা। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক তৈরি পোশাক কারখানা এবং তার উপকরণ সরবরাহকারী বস্ত্র ও সুতাকল। সব মিলিয়ে পোশাক ও বস্ত্র খাতের সেই সম্ভাবনার জায়গাটি অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। কথা হয় বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ঘন ঘন নীতি পরিবর্তনের কারণে রফতানি খাতকে ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই ৫ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ করা দরকার। তাহলে প্রতিবছর ব্যবসায়ীদের আর দাবি-দাওয়া নিয়ে আসতে হবে না। তিনি মনে করেন, ‘উৎসে কর বন্ধ করে দেয়া উচিত। তা না হলে অন্তত আগামী তিন বছরের জন্য এটি বন্ধ রাখা উচিত।’
প্রস্তাবের যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে তিনি বলেন, রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাত ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের চাহিদা কমেছে। গত ১০ বছরে প্রবৃদ্ধি নিচে নেমে গেছে। তার ওপর গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও অবকাঠামোয় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ডিজেলে কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এসব বিবেচনায় নেয়া না হলে অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতি হবে। দেশে তৈরি পোশাকের বিকল্প খাত প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, পৃথিবীর কোথাও রফতানি খাতে উৎসে কর নেই। সুতা-কাপড়, রংসহ বিভিন্ন পর্যায়ে পোশাক প্রক্রিয়াজাত করার আগ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই শুল্ক-কর দিতে হচ্ছে। এরপর রফতানির মূল্যের ওপর দশমিক ৭০ শতাংশ উৎসে কর দিতে হচ্ছে। যা রফতানিকারকদের কাছে বোঝার মতো।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী খোকন স্থানীয় পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য কাঁচা তুলার অপচয় হার ১০-১২ শতাংশ এবং রফতানি দ্রব্য সুতার ক্ষেত্রে কাঁচা তুলার অপচয় হার ১৫-১৮ শতাংশ করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এ ছাড়া মিল থেকে সাময়িকভাবে ধারে তুলা সংগ্রহ করা হলে সেখানে মূসক থেকে অব্যাহতি দেয়া জরুরি। অন্যদিকে বর্তমানে ৩০ লাখ টাকা আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ আয়কর ও ২০ কোটি টাকা সম্পদের ওপর ৩০ শতাংশ হারে সার চার্জ ধার্য রয়েছে। এরূপ উচ্চহার ক্যাপিটাল ফরমেশনকে নিরুৎসাহিত করছে যা বিনিয়োগকেও বাধাগ্রস্ত করছে। ডিভিডেন্ড হিসাবে প্রাপ্ত আয়কেও ব্যক্তির আয় হিসাবে গণ্য না করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
দেশে আজ শিল্প বিপ্লবের যতটা হাঁকডাক, এ তিন উপখাতের উদ্যোক্তারাই তার নেপথ্য নায়ক। খাতভিত্তিক অবদান বিবেচনায় মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) তৈরি পোশাক খাত শীর্ষে রয়েছে।