পাট থেকে পলিথিনের উদ্ভাবক বিজ্ঞানী ড.মোবারক আহমেদ খান বলেছেন, পাট থেকে পলিথিন উদ্ভাবনের বিষয়টি যেভাবে প্রচার পেয়েছে, সেভাবে প্রসারিত হয়নি। এর জন্য প্রয়োজন পৃথক বাজেট, পৃথক পরিচয় ও পৃথক ইনস্টিটিউশন। এই তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। এসব না পেলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে পাট থেকে পলিথিন উৎপাদন প্রকল্প।
বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বিজ্ঞানী ড.মোবারক আহমেদ খান বলেন, ‘১৭০ কোটি টাকার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে পাট থেকে পলিথিন উৎপাদন প্রকল্পের। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় হয়ে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরশন (বিজেএমসি), তারপর লতিফ বাওয়ানী জুট মিল হয়ে সেই টাকা বরাদ্দ পাওয়া এক বিরাট আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এত জটিলতা কাটিয়ে কবে টাকা পাওয়া যাবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আদৌ বরাদ্দ পাওয়া যাবে কিনা তাও পরিষ্কার নয়।’ এসব কারণে বিব্রত ও হতাশ বিজেএমসির বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহমেদ খান।
তিনি বলেন, ‘এর জন্য প্রয়োজন পৃথক বাজেট। প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে পৃথক বাজেট, পৃথক পরিচয় ও পৃথক ইনস্টিটিউশনও প্রয়োজন। এই তিনটি বিষয় ছাড়া এ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’ ড. খান বলেন, ‘মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে এসে কেন একাজে হাত দিয়েছিলাম, এর জন্য এখনও আমার স্ত্রীর সঙ্গে কোল্ড ওয়ার (ঠান্ডা যুদ্ধ) হয়। তার পরও কাজটি চালিয়ে নিতে চাই।’
তিনি জানান, প্রকল্পটি শতভাগ বাস্তবায়নে হয়তো প্রয়োজন হতে পারে ১৭০ কোটি টাকা। সরকারের কাছে এই টাকা চাওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি (৩ মে) রাজধানীর ডেমরায় অবস্থিত সরকারি মালিকানাধীন লতিফ বাওয়ানী জুট মিল প্রাঙ্গণে প্রকল্পের অফিসে বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ক্ষোভের সঙ্গে এসব কথা বলেন পাট থেকে পলিথিনের উদ্ভাবক ড. মোবারক আহমেদ খান।
জুটপলি হাতে ড. মোবারক আহমেদ খানতিনি বলেন, ‘প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রকল্পটির কাজ এগিয়ে নিতে পারিনি। এটার জন্য যে অর্থের দরকার, তা আমার কাছে নাই। পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, বিজেএমসি, সর্বোপরি লতিফ বাওয়ানী জুটমিল কর্তৃপক্ষ সবাই এ ব্যাপারে আন্তরিক। কিন্তু সরকার যেভাবে চাচ্ছে, তা অনেক লম্বা প্রসেস। টাকা চাইলে তাৎক্ষণিক পাওয়া যায় না। সরকারের নিয়মনীতি অনুসরণ করে টাকা পেতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। যেমন ধরুন— এখন এ কাজের জন্য প্রয়োজন হলো ২০ কোটি টাকা। কিন্তু কে দেবে সেই টাকা? বিজেএমসি নাকি মন্ত্রণালয়, নাকি লতিফ বাওয়ানী। সরকারের লম্বা প্রসেসের কারণেই কেউ ঠাকা দিতে পারবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যেভাবে কাজটা আগাচ্ছিলাম, তাতে দেশ- বিদেশে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। দেশে-বিদেশে পাট থেকে তৈরি পলিথিনের এত চাহিদা, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে চাহিদা আমরা পেয়েছি, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি পেয়েছি ইউরোপ, স্ট্রেলিয়া, ইউকে ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। অস্ট্রেলিয়ার সরকার গত পহেলা এপ্রিল থেকে সেদেশে পলিব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। তারা এখন বিকল্প খুঁজছেন। বিকল্প খুঁজতে অস্ট্রেলিয়ার একটি টিম আমার এই প্রকল্প পর্যন্ত এসেছে। শুনেছি, তারা মন্ত্রীর সঙ্গেও নাকি কথা বলেছেন। জাপানিদের সঙ্গেও এ বিষয়ে মন্ত্রীর বৈঠক হয়েছে। তারা প্রতিদিন ১০০ টনের চাহিদা দিয়েছে বলে শুনেছি।’
ড. মোবারক আহমেদ খান বলেন, ‘বাংলাদেশের একটি কোম্পানি থেকেও আমরা এ পলিথিনের চাহিদা পেয়েছি। সেটি হচ্ছে এসিআই কোম্পানি। এসিআই প্রতিদিন ২৫ টন করে পলিথিনের প্যাকেজিং প্যাকেট বানায়। তারা এ পণ্যটি নিতে বেশ আগ্রহী। তারা প্রস্তাব দিয়েছে। এসিআই প্রতিদিন আমাদের কাছ থেকে ১৫শ’ মিটার পাট থেকে উদ্ভাবিত পলিথিন নেবে। আমরা তাতে সম্মতি দিয়েছি। তারা আমার এই পেপার নিয়ে তাদের মেশিনে দিয়ে দেখবে যে, সব ঠিক আছে কিনা। এছাড়া, বাংলাদেশের সুপার সপ অ্যাসোসিয়েশন থেকেও এই পলিথিন নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিসহ একটি প্রতিনিধিদল আমাদের কারখানা পরিদর্শন করে গেছেন। বাংলাদেশের অনেক গার্মেন্টস কারখানাও এই পণ্যটি নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার টেকনোলজি নিয়ে কোনও সন্দেহ নাই। আমার টেকনোলজি নিয়ে আমি খুবই সন্তুষ্ট। এই মুহূর্তে যে কেউ অর্থাৎ সরকারি-বেসরকারি যে কোনও প্রতিষ্ঠান যদি বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে আমি আমার টেকনোলজি ট্রান্সফার করতে পারবো। প্রতিদিন ১০০ টন, ২০০ টন, ৫০০ টন, হাজার টন যেভাবেই ডিমান্ড দিক না কেন, সমস্যা নাই। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে আমারা এই জুটপলি করেছি। এর মেশিনপত্র বিশ্বের কোথাও তৈরি হয় নাই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাকে এর মেশিনপত্র খুঁজতে হচ্ছে। বর্তমানে যা দেখছেন, তা একান্তই আমার নিজের তৈরি। নিজেকেই এগেুলো তৈরি করতে হয়েছে। বলতে পারেন এটি একটি মাইলস্টোন। তবে এর একটি ভালো দিক হলো যে, এখন এর একটি রেপ্লিকা তৈরি হয়ে গেছে। ফলে আরও বড় ও আধুনিক করে এর মেশিনপত্র বানাতে পারবেন। যদি কেউ এগিয়ে আসেন, তাহলে আমি তাকে সাহায্য করবো।’
ড. মোবারক বলেন, ‘এখন আমি বিজ্ঞানী হিসেবে বলবো— এই প্রজেক্ট এগিয়ে নিতে আমার প্রয়োজন সেপারেট বাজেট, সেপারেট আইডেনটিটি অ্যান্ড সেপারেট ইনস্টিটিউশন। এই তিনটি জিনিস পেলেই হবে। এই প্রকল্পের জন্য যদি টাকা চাই, তাহলে মন্ত্রী বলেন, টাকা দেবেন বিজেএমসিকে, বিজেএমসি বলে দেবে লতিফ বাওয়ানীকে। এভাবে টাকা পাওয়া একটি লম্বা প্রসেস। এছাড়া ব্যাগের দাম কত পড়বে? আয় কত হবে? কত ব্যয় হবে, এগুলো লোকসান হবে কিনা, তার হিসাব-নিকাশ আমার কাজ নয়।’
ড. মোবারক আহমেদ খানতিনি বলেন, ‘আমার কাজ হচ্ছে— উৎপাদিত পণ্যটি কীভাবে আরও একটু ভালো করা যায়। কীভাবে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো যায় ইত্যাদি। টাকা খরচ করবে সরকার। আমি তো কোনও টাকা খরচ করি না। আমি শুধু ডিমান্ড দেই যে, এ কাজটুকু করে দাও, সরকার সেটুকু করে দেবে। আমি তো এর বেশি চাই না।’
পৃথক বাজেট, পৃথক আইডেনটিটি ও পৃথক ইনস্টিটিউশন পেতে সমস্যা কোথায়, জানতে চাইলে ড. মোবারক আহমেদ খান বলেন, ‘এগুলো পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে— সরকারের আগ্রহ। বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। আগে কখনও এসব কথা বলিনি। এখন দেখছি না বললে হবে না। হয় সরকার আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী সহযোগিতা দেবে, নতুবা সরকার বলে দেবে— তুমি তোমার টেকনোলজি দিয়ে চলে যাও, আমি চলে যাবো।’
বাংলাদেশ অটোমিক এনার্জি রিসার্চ এস্টাবলিশমেন্টের সাবেক ডিজি ড. মোবারক আহমেদ খান এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এই প্রকল্প যদি মুখ থুবড়ে পড়ে, তাহলে তা পড়বে আর্থিক কারণে। কারণ, আমি এ প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য ১৭০ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছি। এই টাকা পাওয়া যাবে কিনা জানি না। সরকারের কত টাকা কত খাতে ব্যয় হচ্ছে।’
অনেকটা দুঃখ করেই তিনি বলেন, ‘লতিফ বাওয়ানীর যে ইউনিটে প্রকল্পের কাজ চলছে, সেখানকার একটি রুমে আমি বসি। কিন্তু সেই রুমে এসি নাই। লতিফ বাওয়ানী কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম, একটি এসির ব্যবস্থা করতে। কিন্তু তারা দেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে এসেছি বলে আমার স্ত্রীর সঙ্গে এখনও ঝগড়া হয়। জীবনভর গবেষণা করেছি। সংসারের দিকে তো মনোযোগ দেইনি। আমার স্ত্রী একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে চাকরি করছেন। ছেলে কানাডায় পিএইচডি করছে। মেয়ে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ছেলে-মেয়ে, সংসার, সবকিছু আমার স্ত্রী-ই সামলে নিচ্ছেন। সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আমি শুধুই গবেষণা করেছি।’