রানা প্লাজা ধসপরবর্তী প্রেক্ষাপটে পোশাক খাতের কারখানাগুলো দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এক ভাগে রয়েছে বৃহৎ ও কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলো। এসব কারখানা ফুলেফেঁপে আরো বড় হচ্ছে। বাড়ছে ইউনিট সংখ্যা। এসব কারখানায় বেতন-বোনাস নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। অন্যদিকে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো কোনোটা বন্ধ হয়ে গেছে, আবার কোনোটা রফতানি আদেশ না পেয়ে সাব কনটাক্টিং করে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। এই ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোই এখন মাথাব্যথার কারণ।
আসছে ঈদে এসব কারখানা তার শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস দিতে পারবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে এবার জাতীয় নির্বাচনের বছর। এসব ছোট ও মাঝারি কারখানার শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে সরকার বিরোধী পক্ষ। বিষয়টি মাথায় নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সরকার ও মালিক পক্ষ।
জানা গেছে, এই মুহূর্তে উৎপাদনে নেই দেড় হাজারেরও বেশি রফতানিমুখী পোশাক কারখানা। এর মধ্যে কিছু কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু কারখানায় নেই রফতানি আদেশ। কাজ না থাকায় এসব কারখানাও বন্ধ হওয়ার পথে। ফলে এসব কারখানার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস কীভাবে হবে তা নিয়ে আছে শঙ্কা। এত কারখানা বন্ধ হওয়ায় পোশাক খাত যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি মালিক এবং শ্রমিক উভয় শ্রেণিই বিপদে পড়েছে। জানা গেছে, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর নিয়মিত উৎপাদনে না থাকাসহ অন্যান্য কারণে ৫৫০ কারখানার সদস্যপদ বাতিল করেছে বিজিএমইএ।
আয়-ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় ৩০০ কারখানা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছে মালিক পক্ষ। নিয়মিত উৎপাদনে না থাকার কারণে ১৮০ কারখানার সদস্যপদ বাতিল করেছে বিকেএমইএ। বিকেএমইএভুক্ত ২০০ কারখানা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকরা। সংস্কার কার্যক্রমে অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় এ পর্যন্ত ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ২৩২ কারখানা। এসব কারখানার সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন ক্রেতারা। এ কারখানাগুলো দুই জোটের কোনো ক্রেতার রফতানি আদেশ পাচ্ছে না। কার্যত এসব কারখানা এখন বন্ধ।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর সভাপতিত্বে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কোর কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রাজাধনীসহ বিভিন্ন স্থানের ২০০ পোশাক কারখানায় ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অ্যাফেয়ার্স) মো. মনিরুজ্জামান সভায় বলেন, ক্রাইসিস হয়ে গেলে সামর্থ্য না থাকলেও পেমেন্টে করতেই হয়, সে জন্য আগে থেকে করাটাই ভালো। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের ১২২টি, ঢাকার বাইরের আরো ৪৮টিসহ মোট ২০০ গার্মেন্টস ঈদের আগে বেতন-ভাতা দিতে পারবে না বলে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। যদি ২০টি গার্মেন্টসে সমস্যা হয় তাহলে মানুষের ঈদ মাটি। রোড বন্ধ হয়ে গেলে উত্তরবঙ্গ রুট, চট্টগ্রামের রুট এবং সিলেটের রুটে বন্ধ হয়ে যাবে। কাজেই অনুরোধ করবো ওয়ান টু ওয়ান বসে সমস্যা সমাধান করতে। তিনি আরো বলেন, এটা নির্বাচনী বছর, ঈদের আগে শ্রমিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে কেউ ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, যেসব পোশাক কারখানা আমাদের মেম্বার না, আমরা তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারি না। কমপ্লায়েন্স না হলে আমরা এখন কোনো কারখানাকে মেম্বার করছি না। আমরা এখন ডাটাবেজ করছি। এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত আমাদের মেম্বার কারখানাগুলোর শ্রমিক সংখ্যা ৩০ লাখ। এ ছাড়া আমরা কারখানার ম্যাপিংও করছি। তবে সমস্যা ছোট ও নন-কমপ্লায়েন্স কারখানাগুলো নিয়েই হবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। বিজিএমইএ মেম্বার না হলেও কোনো ছোট
কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় বের হলে তা প্রভাবিত করবে গোটা পোশাক খাতকে। তখন যে বিজিএমইএ আর কে বিজিএমইএর সদস্য নয় তা কেউ বিবেচনায় নেবে না বলেই মনে করছেন শ্রমিক সংগঠনগুলো। এ প্রসঙ্গে কথা হয় জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনির সঙ্গে। তিনি মানবকণ্ঠকে বলেন, সরকার একটা তালিকা করেছে। এগুলো সবই নন-কমপ্লায়েন্স কারখানা। এরা রফতানি আদেশ না পেয়ে মূলত সব কনটাক্টিং করে টিকে আছে। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স আসার পর এই কারখানাগুলো অনেকটাই বেকার হয়ে গেছে। তবে মালিকপক্ষ ও সরকার সচেতন রয়েছে, যাতে কোনোভাবেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটিয়ে কেউ ফায়দা নিতে না পারে। তিনি বলেন, নির্বাচনী বছরে কেউ যাতে আগুনে ঘি ঢেলে দিতে না পারে সেদিকে সবাইকে নজর রাখতে হবে।
এদিকে এবার ঈদ মাসের মাঝামাঝি হওয়ায় আরেক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে জুন মাসের অর্ধেক বেতন প্রদানের দাবি জানানো হলেও মঙ্গলবারের বৈঠক থেকে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মে মাসের বেতন ১০ জুনের মধ্যে এবং ১৪ জুনের মধ্যে ঈদবোনাস দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। আর জুন মাসের আংশিক বেতন কোনো মালিক সদয় হলে দিতে পারেন বলেও জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি জানান, আইনগতভাবে মালিকরা মে মাসের বেতন ৭ তারিখের মধ্যে দিতে বাধ্য। চলতি মাসের বেতন দিতে তারা বাধ্য নয়। তাদেরও আগ্রহও নেই বলে তিনি জানান। গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু এ প্রসঙ্গে বলেন, ঈদে উত্তরবঙ্গের একজন শ্রমিকদের বাড়ি যাতায়াত করতে সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। সেখানে অনেক কারখানায় ৫০০-৬০০ টাকাও বোনাস ধরিয়ে দেয়। এই টাকা নিয়ে তারা কিভাবে বাড়ি যাবেন। আমরা অনুরোধ করেছিলাম জুন মাসের অর্ধেক বেতন যাতে ঈদেও আগে দেয়া হয়। এতে শ্রমিকরা হাসি-খুশি নিয়ে বাড়ি যেতে পারবেন। কিন্তু সরকার মালিকদের এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশ দেয়নি। বলেছে, কেউ পারলে দেবে। এটা কোনো শ্রমিকবান্ধব সরকারের কথা হতে পারে না।
এবারের সার্বিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মোশরেফা মিশু বলেন, প্রতিবছর কিছু কারখানায় সমস্যা হয়। আমরা ঈদের দিনেও কর্মসূচি পালন করেছি। এবার সরকার ২০০ কারখানার তালিকা করেছে। আমরা মনে করি এই সংখ্যা আরো বেশি হবে। ১০ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক এখন বোনাস পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে। এই অবস্থায় যাতে কোনো সঙ্কট তৈরি না হয় সে জন্যই আমরা বারবার ২০ রমজানের মধ্যে বেতন ও বোনাস এবং ২৫ রমজানের মধ্যে ছুটি দেয়ার দাবি জানিয়েছি। কিন্তু তা না করে ১৪ জুন তথা ২৮ রমজানের মধ্যে বোনাস দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এভাবে টেনে নিয়ে গিয়ে সঙ্কট আরো ঘনীভূত করা হয়। বোনাস যেহেতু দিতেই হবে তাহলে শেষ দিন কেন? এ কারণেই কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের মধ্যে শঙ্কা বাড়ে এবং অনেক সময় তারা রাস্তায় বের হয়ে আসে। এমর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তার জন্য সরকারকেই দায়ী করব আমরা।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার জানান, এবার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। এখনই অনেক গার্মেন্টসে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এবার শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো নির্ধারণের জন্য যে কমিটি করা হয়েছে ওই কমিটি বৈঠকই করতে পারছে না। তারিখ ঠিক হলেও বিজিএমইএ সভাপতি বিদেশে চলে যান। মালিক পক্ষের অসহযোগিতার কারণে ওই বৈঠকগুলো হচ্ছে না। এবার ঈদে বেতন-বোনাসের সঙ্গে এই ইস্যুটা যুক্ত হতে পারে। ফলে শ্রমিক আন্দোলনের আশঙ্কা আছে বলে তিনি মনে করছেন।