সব শিল্প খাতের শ্রমিকদের মে মাসের বেতন পরিশোধের কথা ছিল ১০ জুন। ওইদিন বেতন পরিশোধ না করায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয় ঢাকার নোমান ফ্যাশনে। ঘোষিত সময়ের একদিন পর গতকালও বেতন পাননি পোশাক কারখানাটির সাড়ে ৭০০ শ্রমিক।
ঘোষিত সময়ে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে পারেনি গাজীপুরের জাহিন টেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের ইউনিট-১ও। বেতন নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়ায় কারখানাটি পর্যবেক্ষণে রেখেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। ঘোষিত সময়ে অর্থাৎ ১০ জুন বেতন না পাওয়ায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জের তারাবোতে এনএম ফ্যাশনেও।
প্রতি বছরই ঈদের আগে বেতন পরিশোধ নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা থাকে। পরিস্থিতি এড়াতে মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠক থেকেই বেতন ও বোনাস পরিশোধের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়। এবারো সব শিল্প খাতে মে মাসের বেতন ১০ জুনের মধ্যে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মালিকরা। আর বোনাস পরিশোধের ঘোষণা দিয়েছেন ১৪ জুনের মধ্যে।
যদিও শিল্প পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, গতকাল পর্যন্ত দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোর ৪৩ শতাংশ কারখানা শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করেছে। বাকি ৫৭ শতাংশ কারখানার শ্রমিকই প্রতিশ্রুত সময়ে বেতন পাননি।
দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে আশুলিয়া গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনা। শিল্প পুলিশের হিসাবমতে, এসব অঞ্চলে শিল্প-কারখানা রয়েছে মোট ৭ হাজার ৭৮টি। এর মধ্যে পোশাক খাতের কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ২৮৮ ও অন্যান্য খাতের ৩ হাজার ৭৯০। সব কারখানা মিলে ঘোষিত সময়ে বেতন পরিশোধ করেছে ৩ হাজার ২২টি। বাকি ৪ হাজার ৫৬টি কারখানা এখনো বেতন পরিশোধ করতে পারেনি। এছাড়া বোনাস পরিশোধ করেছে ১ হাজার ৫৬৬টি কারখানা।
ঈদের আগ পর্যন্ত বেতন-বোনাস পরিশোধ চলবে বলে জানান শিল্প পুলিশের মহাপরিচালক অ্যাডিশনাল আইজিপি আবদুস সালাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বেতন-বোনাস পরিশোধ প্রক্রিয়া এখনো চলছে। বন্ধের আগের দিন পর্যন্তও চলবে। এ সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক থাকে, সে বিষয়ে নজরদারি করে যাচ্ছি আমরা। আশা করছি, তেমন কোনো সমস্যা হবে না। যেসব কারখানা অসন্তোষপ্রবণ, সেগুলো কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
শিল্প পুলিশের সূত্রমতে, বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়ে অসন্তোষের আশঙ্কা রয়েছে চামড়া ও আবাসনসহ মোট ৪৪২টি কারখানায়। এসব কারখানার আওতায় শ্রমিক রয়েছেন ৪ লাখ ২৬ হাজার ২৩৮ জন। অসন্তোষপ্রবণ কারখানাগুলোর মধ্যে পোশাক খাতের কারখানার সংখ্যা ২৮৮, যেগুলোয় কর্মরত ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৭৩৯ শ্রমিক। এর মধ্যে ১৬৫টি কারখানা আবার বিজিএমইএর সদস্য। অবশিষ্ট ৮৬টি বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানা। আর ১৪টি কারখানা রয়েছে বিটিএমএর সদস্যভুক্ত।
পোশাক খাতে বেতন পরিশোধ পরিস্থিতি জানতে যোগাযোগ করা হয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে (ডিআইএফই)। সংস্থাটি জানায়, তাদের তালিকায় অসন্তোষপ্রবণ পোশাক কারখানা ২৮২টি। এর মধ্যে ঢাকায় ৭৬টি, গাজীপুরে ১০৫, নারায়ণগঞ্জে ৪০ ও চট্টগ্রামে ৬১টি।
ঈদুল ফিতরে শ্রম পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম চালু করেছে ডিআইএফই। কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কাছ থেকে টেলিফোনে বেতন-বোনাস পরিশোধের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের তথ্যও বলছে, বিভিন্ন শিল্প অধ্যুষিত অঞ্চলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কারখানা এখনো বেতন পরিশোধ করতে পারেনি।
ডিআইএফই মহাপরিদর্শক মো. সামছুজ্জামান ভূইয়া বলেন, বেতন-বোনাস পরিশোধ চলছে। বড় ধরনের অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। যেসব কারখানায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ছোট ও সাব-কন্ট্র্যাক্ট ভিত্তিতে পরিচালিত। নারায়ণগঞ্জে এমন একটি কারখানা ঋতিকা। কারখানাটির মালিক লাপাত্তা। এছাড়া একটি কারখানার মালিক আত্মহত্যা করেছেন বলে জানতে পেরেছি। অসন্তোষপ্রবণ কারখানাগুলোয় আমাদের বিশেষ নজরদারি রয়েছে।
শিল্প পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, শিল্প অধ্যুষিত সব এলাকায়ই কম-বেশি অসন্তোষপ্রবণ কারখানা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ রয়েছে শিল্প পুলিশ-১ বা আশুলিয়ার কারখানাগুলো ঘিরে। শিল্প পুলিশের দাবি, এ এলাকায় বহিরাগত শ্রমিক নেতারা আছেন, যারা বিভিন্ন সময় সমস্যার সৃষ্টি করেন। এ কারণেই আশুলিয়া এলাকা ঘিরে বিশেষ নজরদারি রয়েছে শিল্প পুলিশের।
পোশাক খাতের বেতন-বোনাস পরিশোধ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাসির বলেন, অধিকাংশ কারখানাই বেতন পরিশোধ করেছে। মালিক-শ্রমিক সমঝোতার ভিত্তিতে বোনাস পরিশোধও চলছে। ১৭-১৮টি কারখানায় সমস্যা ছিল, যেগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়েছে।
শিল্প পুলিশ-১ আশুলিয়ায় অসন্তোষপ্রবণ কারখানা রয়েছে ৯৭টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ৩১, বিকেএমইএর ১৭, বিটিএমএর ২ ও অন্যান্য খাতের কারখানা ৪৭টি। শিল্প পুলিশ-২ গাজীপুরে অসন্তোষপ্রবণ কারখানা রয়েছে ১৩৩টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ৬৬, বিকেএমইএর ১৯ ও বিটিএমএর সদস্য তিনটি। এছাড়া অন্যান্য খাতের ৪৫টি কারখানাও রয়েছে, যেগুলোয় অসন্তোষের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিল্প পুলিশ-৩ চট্টগ্রামে অসন্তোষপ্রবণ কারখানার সংখ্যা ৯২। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ৪৩, বিকেএমইএর চার ও বিটিএমএর সদস্য সাতটি। বেপজার আওতায় ইপিজেডের কারখানা রয়েছে ১৪টি। এছাড়া অন্যান্য খাতের কারখানার সংখ্যা ২৪। শিল্প পুলিশ-৪ নারায়ণগঞ্জে অসন্তোষপ্রবণ কারখানা ৮৫টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ১১টি। এছাড়া বিকেএমইএর সদস্য কারখানা রয়েছে ৪৬, বিটিএমএর সাত ও অন্যান্য খাতের কারখানা ২১টি।
শিল্প পুলিশ-৫ ময়মনসিংহে অসন্তোষপ্রবণ কারখানা রয়েছে ২৪টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ১৪টি, বিটিএমএর চার ও অন্যান্য খাতের কারখানা ছয়টি। এছাড়া শিল্প পুলিশ-৬ খুলনায় অসন্তোষপ্রবণ কারখানা রয়েছে ১১টি। সব কারখানাই পোশাক খাতের বাইরের।
জানতে চাইলে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, বরাবরের মতো এবারো ঘোষিত সময়ে বেতন পরিশোধ শেষ করেননি পোশাক কারখানা মালিকরা। ৭০ শতাংশের মতো কারখানা বেতন পরিশোধ করেছে। কিছু কারখানা বোনাসও পরিশোধ করেছে। বড় ধরনের কোনো সমস্যার ঘটনা ঘটেনি।