পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে চীন। তুলার চাহিদা মেটাতে চীনের আমদানিকারকরা তাই ঝুঁকছেন ভারতের দিকে। এ সুযোগে পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ভারতীয় রফতানিকারকরা। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের বস্ত্র খাতের ওপর। কারণ বাংলাদেশে তুলার চাহিদার প্রায় অর্ধেকই আসে ভারত থেকে।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার মূল্যবৃদ্ধি দেশের সুতার বাজারেও অস্থিরতা তৈরি করছে। তুলার মূল্যবৃদ্ধির কারণে সুতার দামও বেশি চাইছেন স্পিনাররা।
নিট পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এমবি নিট ফ্যাশন গত সপ্তাহে দেশের একটি স্পিনিং মিল থেকে সুতা কিনতে চেয়েছিল। ৩০ সিঙ্গেল কার্ড কটন সুতার দাম ঠিক হয়েছিল প্রতি কেজি ৩ দশমিক ২৫ ডলার। ক্রয় চুক্তি চূড়ান্ত করতে চলতি সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটি যোগাযোগ করলে স্পিনার কেজিপ্রতি ৩ দশমিক ৩৫ ডলার দাবি করেন।
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে এ বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে বলে জানান এমবি নিট ফ্যাশনের কর্ণধার মোহাম্মদ হাতেম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের যে আভাস ছড়িয়ে পড়েছে, তার প্রভাবেই সুতার দাম বাড়াচ্ছেন স্পিনাররা, এটা দুঃখজনক। কারণ বর্ধিত মূল্যের তুলা এখনো আমদানি হয়নি। এ অবস্থায় আমরা আমদানির কথা ভাবছি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারেও মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কটন অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএ) ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সূত্রমতে, জানুয়ারি থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম ঊর্ধ্বমুখী। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তুলার দাম বেড়েছে পাউন্ডপ্রতি ২০ সেন্ট। গত জানুয়ারিতে প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ছিল ৭৬ সেন্ট। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯০-৯৫ সেন্ট। চীন-যুক্তরাষ্ট্র পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপ পণ্যটির দাম আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কটন অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসেই দেশটিতে সঙ্কর-৬ জাতের তুলার দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। আর ১০ শতাংশ বেড়েছে কটন সুতার দাম।
বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে চীনের ২৫ শতাংশ শুল্কারোপের পর ভারতীয় তুলার চাহিদা বেড়ে গেছে। চীনারা ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানির চুক্তি করেছে। এ সুযোগে তারাও পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। দুই দেশের বাণিজ্যযুদ্ধের এ চাপে পিষ্ট হতে শুরু করেছে বাংলাদেশের মতো তুলা আমদানিনির্ভর দেশগুলো।
বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটটি নিয়ে শুরুতে আশাবাদী ছিলাম। আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম যখন কমে গেল, তখন আমরা অপেক্ষা করছিলাম আরো দাম কমার। তাতে এ যুদ্ধে আমরা লাভবান হব, এমন আশাই ছিল। কিন্তু হয়েছে এর উল্টোটা। আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম আরো বেড়ে গেছে।
সূত্রমতে, বাংলাদেশে নিট পোশাকের জন্য প্রয়োজনীয় সুতার ৯০ শতাংশ সরবরাহ করে বিটিএমএ সদস্য স্পিনিং মিলগুলো। ওভেন পোশাকের সুতারও ৪০ শতাংশ সরবরাহের সামর্থ্য রয়েছে বিটিএমএর সদস্য কারখানাগুলোর। এ সুতা উৎপাদনের কাঁচামাল তুলার অর্ধেকই আসে প্রতিবেশী ভারত থেকে। বর্তমানে বছরে ৬০ লাখ বেলের বেশি তুলা আমদানি হয় দেশে। দুই দশক আগে দেশের স্পিনিং খাতের উত্থানের সময় আমদানিকৃত তুলার ৫০ শতাংশই আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এরপর কিছুদিন তুলার মূল উৎস ছিল উজবেকিস্তান। ২০০৪ সালের দিকে মূল্য ও আমদানির সময় বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে ওঠে ভারত। সেই থেকে ক্রমেই বাংলাদেশের তুলা আমদানিতে ভারতনির্ভরতা বাড়ছে। ২০১৬ সালেও মোট তুলা আমদানির প্রায় ৫৫ শতাংশই হয় ভারত থেকে। ২০১৭ সালে তা কিছুটা কমে ৪৬ শতাংশে নেমে আসে। কম সময়ের মধ্যে আমদানির সুযোগের কারণেই মূলত তুলা আমদানিতে ভারতের ওপর এ নির্ভরতা।
তুলা ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিসিএর সভাপতি মেহেদী আলী বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় তুলার বড় উৎস ভারত। আর তুলার মূল্যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বিদ্যমান রয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে তুলার দাম যেভাবে বাড়ছে, গত ছয় বছরেও তা দেখা যায়নি।
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মেহেদী আলী বলেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তুলার এ মূল্যবৃদ্ধি স্বাভাবিক ঘটনা। বাস্তবতা হলো, মানসম্পন্ন তুলার মূল উৎপাদক দেশগুলোয় পণ্যটির মজুদ শেষ হয়ে এসেছে। এখন শুধু আফ্রিকা অঞ্চলে তুলা পাওয়া যাচ্ছে। নতুন তুলা আসবে সেপ্টেম্বরে। তখন তুলার দাম আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। এ পরিস্থিতিতে বস্ত্র ও পোশাক শিল্প মালিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তবতার দিকে নজর রাখা। এখন কারো হাতেই তুলার মজুদ নেই। নভেম্বর-ডিসেম্বরে যখন মজুদ ছিল, তখন কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারসাজি নয়, বরং মজুদ শেষ হওয়ায় মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে এটা বেশি দিন স্থায়ী হবে না। নতুন তুলা এলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বাংলাদেশে ওভেন পোশাকের কাপড়ের সুতারও উল্লেখযোগ্য আমদানি হয় ভারত থেকে। তুলার মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেখানকার সুতার দামও এখন ঊর্ধ্বমুখী, যা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে পোশাক শিল্প মালিকদেরও।
তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, তুলার মূল্যবৃদ্ধিতে স্বাভাবিক নিয়মেই সুতার দাম বাড়বে। আর সুতার বর্ধিত মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে কাপড়ের দাম। এর চূড়ান্ত প্রভাব পড়ছে আমাদের ওপর।