১.
এইতো কিছু দিন আগে আমার পরিচিত কমপ্লায়েন্সের একজন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর দেশের একটা সুপরিচিত গ্রুপ থেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলেন। নাম করা সেই গ্রুপের ফ্যাক্টরিগুলোতে মেয়েদের কে যথাযথভাবে মাতৃত্বকালীন সুবিধা দেওয়া হতো না। কেউ গর্ভবতী হলে তাকে বিভিন্ন অযুহাতে বের করে দেওয়ার প্রচেস্টা চলতো, একান্তই বের করতে না পারলে প্রথম দফার টাকা দিয়েই দুই দফার পেমেন্ট শিটে স্বাক্ষর নিয়ে রাখা হতো, পরের পেমেন্ট আর দেওয়া হতো না। উনি এইসব দেখে মাথা গরম করে দিলেন মালিক কে ফোন।মালিক উনার কথা ঠান্ডা মাথায় শুনলেন, আইডিয়া নিলেন,ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রাখলেন। সন্ধ্যায় এইচ আর হেড উনাকে ফোন করে উনার চাকরির অবসানের সংবাদ জানালেন। উনি চুপ হয়ে গেলেন, নিজের অবস্থানের কথা চিন্তা করে আইনী পথে না গিয়ে ভদ্রতাবশত মেইল করে রিজাইন লেটার পাঠিয়ে দিলেন।
২.
বেশ অনেক দিন আগের কথা।তখনো আমরা অনেক ফ্রেন্ডই বেকার, কোচিং এ ক্লাস নেই, স্টুডেন্টস পড়াই,একটা চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াই, মাঝেমধ্যে বিজনেসের প্ল্যান করি।হুট করেই শুনি এক ফ্রেন্ডের দেশের প্রথম সারির এক গার্মেন্টসের এইচ আরে জব হয়ে গেছে।এইচ আরে পড়াশুনা কর সেই সেক্টরেই জব হওয়াটা তো বিশাল উপলক্ষ্য। বেচারার হাতে টাকাপয়সা নাই, আমরা সবাই লোন দিয়ে সেই টাকায় ট্রিট খাই, কথা হয় প্রথম বেতন পেলেই সেই লোন শোধ করে দিবে। মাসের শেষে টাকাপয়সা চাইতে গেলে বন্ধু আমার জানায় যে তাদের ওখানে জামানত হিসেবে প্রথম মাসের সেলারি রেখে দেওয়া হয়, নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলে গেলে,যাওয়ার সময় এই টাকা টা দিয়ে দেওয়া হয়। “চাকরীর ক্ষেত্রে সেলারি জামানত” এই ব্যাপারটা সেই সময় বেশ কিছুদিন আমাদের হাসি ঠাট্টার ভালো একটা টপিক ছিলো।
৩.
এখনো এমন অনেক অনেক গার্মেন্টস আছে যেখানে স্টাফদেরকে সেলারী দেওয়ার নির্দিস্ট কোন তারিখ নেই। এই মাসে সাত তারিখে সেলারি হইছে তো এর পরের মাসে সেলারি হয় গিয়ে একুশ তারিখে। অফ সিজনের অযুহাতে কোন মাসের স্টাফ সেলারি পরে দেওয়া হয় বা এই মাসে অর্ধেক আর বাকী অর্ধেক এর পরের মাসে। আইনে স্টাফদেরকে শ্রমিক বলা হলেও যারা সরাসরি উৎপাদনের সাথে জড়িত শুধু মাত্র তাদের অধিকার এবং সুবিধাদির ব্যাপারেই আমাদের বায়ার এবং অডিটরেরা উদবিগ্ন থাকেন, স্টাফরা শুধুই জলে ভাসা পদ্ম যেনো। তারা ঠিক সময়ে বাড়িভাড়া দিতে পারেন না বলে বাড়িওয়ালার সাথে সমস্যা, দোকান বাকী পরিশোধ করতে দেরি হয় বলে দোকানদার শ্রমিকদেরকে বাকী দিতে চাইলেও স্টাফদের ব্যাপারে নিমরাজী। ছেলেমেয়ের স্কুল কলেজের বেতন দিতে দেরি হওয়া নিয়ে সংসারে অশান্তি। সব মিলিয়ে একজন স্টাফ এইসব পরিস্থিতিতে তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে পারে না। আর এখান থেকেই শুরু হয় নিজের পেশার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন!
৪.
ফ্যাক্টরির মালিক স্টাক এয়ার, নয়েজ, হিউমিডিটি বা টেম্পারেচার টেস্ট করানোর জন্য কোন টাকা খরচ করবেন না।লাইনের প্রোডাকশন বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিকদেরকে ট্রেনিং এর জন্য দিবেন না।ফায়ার ড্রিল তো কর্মঘন্টা নস্ট। ক্যামিকেলের মধ্যে কাজ করার জন্যই তো ওদেরকে নিয়োগ দেওয়া হইছে, এদের আবার বছর বছর হেলথ টেস্ট কেন!! অডিট পাস করানোর জন্য এইসব ফালতু কাজে যদি টাকা নস্ট করতে হয় তাহলে বেতন দিয়ে তোমাদেরকে রাখছি কেন? ফ্যাক্টরির কমপ্লায়েন্স টিমের সাথে অনেক মালিকেরই কথার সুর থাকে এমন ।
৫.
আমাদের এই সেক্টরে এখনো অনেক ফ্যাক্টরিতে এইচআরডি কে “হুদাই রাখা ডিপার্টম্যান্ট” বলা হয়। এরা সারাদিন কম্পিউটারের সামনে বসে থাকে, প্রোডাকশনের সময় নস্ট করে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে, শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধার কথা জানায় দিয়া ওদের চোখ খুলে দেয়, ঝামেলা বাড়ায়। প্রোডাকশনের কাজ করতে গেলে একটু গালাগালি হবেই, দুই চারটা থাপ্পড় না দিলে ওয়ার্কার আবার কাজ করে না কী কিন্তু এই জায়গাতেও এই অলস মানুষদের নাক গলানো লাগে। এরা আসে আমাদের বিচার করতে !! অধিকাংশ প্রোডাকশন ম্যানাজারদের মনোভাবই এমন । আর এইচ আর যেহেতু সরাসরি প্রোডাকশন দিতে পারে না তাই মালিকও এদের সাথে বিমাতা সুলভ আচরনই করে। উপরের অধিকাংশ ব্যাপারই আমাদের এইচ আর , এডমিন, কমপ্লায়েন্সের মানুষদের কাছে পরিচিত ঘটনা। আমাদের কে শ্রমিকদের কথা শুনতে হয়, আমাদের কে মালিকের কথা মানতে হয়। কোন ব্যাপারে সমস্যা হলে শ্রমিক দোষ দেয় আমাদেরকে আর পরিস্থিতি সামাল দিতে মালিক অকারনেই করে চাকুরীচ্যুত। ঈদ বোনাসের ক্ষেত্রে নন প্রোডাক্টিভ এই স্টাফদের জন্য থাকে শত রকমের যদি কিন্তু মিলানোর ব্যাপার। সার্ভিস বেনিফিট নামক শব্দটা এদের জন্য হারাম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এদের ফ্যামিলি বলে কিছু নেই, ফ্যামিলিকে সময় দেওয়ার কোন ব্যাপার। এরা এলিয়েন প্রজাতি। এদের জন্য অফিসের নির্দিস্ট কোন সময় নেই। সারা দিন ফ্লোর দেখো, ডিসিপ্লিনারি একশনে যাও, মেয়েটা কেন তার প্রোডাকশন টার্গেট হিট করতে পারছে না তা দেখো, তাকে বুঝাও আর ফ্লোর ছুটির পর তোমার ডিপার্টম্যান্টাল কাজ করো।
এই যে এতো অন্যায় আচরন, তারপরও আমাদেরকে চুপ করে থাকতে হয়। সবচেয়ে বেশি আইন প্র্যাক্টিস করা আমাদেরকেই নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি চুপ থাকতে দেখা যায়। তার এক মাত্র কারন হচ্ছে চাকরি হারানোর ভয়। আজ আমার উপর অন্যায় আচরন হলে আমি যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে এর প্রতিবাদ করে, সমাধান চাই তাহলে আমার চাকরি থাকছে না। সেই অসহায় সময়টায় আমি আমার পাশে কাউকে পাচ্ছিও না। ফেসবুক খুললে দেখি আমাদের অনেক অনেক সংগঠন, অনেক অনেক চা চক্র হচ্ছে, ট্রেনিং হচ্ছে, গেট টুগেদার হচ্ছে কিন্তু আমাদের রুটিরুজির প্রশ্নে আমরা উচ্চকন্ঠে কথা বলতে পারছি কী? এতো মত,এতো পথ না থেকে আমাদের একটা সংগঠন কী থাকতে পারে না যেখান থেকে আমাদের উপর অন্যায় আচরন হলে এর জোরালো প্রতিবাদ জানানো হবে? অন্যায়ভাবে কেউ চাকরি হারালে তাকে আইনী সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে?
আজ একজন ডাক্তারের উপর অন্যায় আচরন হলে ডাক্তার পরিবার ক্ষোভে ফেটে পরে, একজন সাংবাদিকের উপর অন্যায় হলে অনলাইন অফলাইন সবখানেই চলে কঠিন প্রতিবাদ। আমরা কী আমাদের জায়গাতে একটু ছাড় দিয়ে এমন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারি না যেটা হবে “ভয়েজ অব এইচ আর পিপলস”? আমরা কী এক সুরে কথা বলতে পারি না? আমাদের উপর কোন অন্যায় আচরন হলে আমরা কী একসাথে প্রতিবাদ করার একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারি না?? আমাদের এই সেক্টরে যাদেরকে গুরু হিসেবে জানি এবং মানি উদ্যোগটা তাদেরকেই নিতে হবে।
সিনিয়র অফিসার
এইচ আর এন্ড কমপ্লায়েন্স
ভিনটেজ ডেনিম এপারেলস লিমিটেড