পোশাক খাতে বছরে লেনদেন হচ্ছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এ খাতে কম-বেশি ৪৪ লাখ শ্রমিক সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ব্যাংক-বীমা, অর্থাৎ পণ্য ও পরিবহনের একটা বড় অংশই চলছে পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে। সরাসরি রফতানি আয়ের বাইরে ২০১৭ সালে পোশাক খাতকেন্দ্রিক আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা। বিজিএমইএসহ সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ব্যাংক খাতে পোশাক খাতের অবদান ছিল পাঁচ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। পরিবহন খাতে ছিল এক হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। দুই হাজার ৬০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি বাবদ। অফিস ভাড়া দেওয়া হয়েছে দুই হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। বন্দর সেবা চার্জ দেওয়া হয়েছে ৫৪৬ কোটি টাকা। এ সময় মজুরি দেওয়া হয়েছে ৩১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। প্রকৌশল খাতে ব্যয় হয়েছে ৫১৫ কোটি টাকা। এভাবে হোটেল ও পর্যটন খাতে ব্যয় হয়েছে ১৫৫ কোটি টাকা। উৎসে কর পরিশোধ করা হয়েছে এক হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা।
পোশাক খাতের একজন শ্রমিকের বেতনে পরিবারের পাঁচজনের ভরণ-পোষণ চলে। এ হিসাবে আড়াই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। এর বাইরে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা উৎপাদন পর্যায়ে সম্পর্কিত পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প এবং ফরওয়ার্ড লিংকেজ বা উৎপাদনের পর ভোক্তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত শিল্প মিলে অসংখ্য সহশিল্প এবং সেবার সংযোগ রয়েছে। এসব খাতেও ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান হচ্ছে।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, গোটা অর্থনীতির প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পোশাক খাত। তবে এ খাতের সবচেয়ে বড় অবদান কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন, জিডিপিতে তৈরি পোশাকের অবদান এখন ১৩ শতাংশ। এ ছাড়া ৪৪ লাখ শ্রমিক এখন পোশাক কারখানায় কাজ করছেন। তাদের প্রায় সবার পক্ষে অন্য কোনো কাজ করা সম্ভব ছিল না। কাজ পাওয়াও যেত না। তখন অর্থনৈতিক দুর্দশার পাশাপাশি সামাজিক বিশৃঙ্খলা অনিবার্য ছিল। পোশাক খাত জাতিকে সেই দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি দিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
পোশাক তৈরির প্রধান উপকরণ কাপড় বা ফেব্রিকস উৎপাদন অর্থাৎ ব্যাকওয়ার্ড শিল্প হিসেবে বস্ত্র খাতে প্রায় ১০ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে। বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সচিব মনসুর আহমেদ জানান, বস্ত্র খাতেও একইভাবে হিসাব করলে ৫০ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা চলছে। ৪৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে বস্ত্র খাতে। এক পিস পোশাক উৎপাদনে অন্তত ৪০ রকম এক্সেসরিজ ব্যবহূত হয়। এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএপিএমইএর সভাপতি আবদুল কাদের খান জানিয়েছেন, এক্সেসরিজ খাতে কর্মসংস্থান রয়েছে পাঁচ লাখ। পরিবারের সংখ্যা হিসেবে ২৫ লাখ লোকের জীবিকা চলে তাদের আয়ে। এ খাতে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের তথ্য দিয়েছেন তিনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম অর্থনীতিতে পোশাক খাতের অবদান ব্যাখ্যা করে বলেন, ব্যাকওয়ার্ড, ফরওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প ছাড়াও অনেক পণ্যসেবা জড়িত পোশাক খাতের সঙ্গে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, তৈরি পোশাক কারখানার ভবনগুলো নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকার নির্মাণসামগ্রী এবং কর্মসংস্থান হচ্ছে। এভাবে অন্যান্য শিল্পের কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগ বিকশিত করছে পোশাক খাত। অর্থাৎ অর্থনীতিতে এ শিল্পের অবদান হিসাব করে শেষ করা যাবে না। তবে ফরওয়ার্ড লিংকেজ থেকে আরও বিশাল অঙ্কের সুবিধা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যেমন বিদেশে ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান করা, বিদেশে খুচরা বিক্রি প্রতিষ্ঠান চালু ও সংশ্নিষ্ট অন্যান্য সেবা খাতে সংযোগ বাড়ানোর বড় সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, সফলভাবে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন, স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকবে তৈরি পোশাক খাতের।
মোট রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। টেরি টাওয়েল হোমটেক্সটাইল মিলে এ হার ৮৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত গত ১১ মাসে পোশাক খাতের রফতানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি আয় হয়েছে। আগের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এ সময়ের সব পণ্যের গড় রফতানি আয়ের তুলনায় এ হার বেশি। গড়ে রফতানি ৭ শতাংশেরও নিচে। এ সময় পোশাক রফতানি থেকে আয় এসেছে দুই হাজার ৮১৩ কোটি ডলার। এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন হাজার ১৬ কোটি ডলার। আর মাত্র তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পোশাক খাত থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যামাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এ লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে বিজিএমইএ।