বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ১৩৯টি আইটেমের পণ্য। এর মধ্যে শুধু প্যান্ট ও টি-শার্ট থেকেই আয় হয়েছে এক-তৃতীয়াংশের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। গত অর্থবছরে জাতীয় রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধু প্যান্ট ও টি-শার্ট রপ্তানি করেই গত অর্থবছরে ১২ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে বাংলাদেশ, যা বাংলাদেশ থেকে সমাপ্ত অর্থবছরে মোট জাতীয় রপ্তানির ৩৪.৫৮ শতাংশ। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের প্রধান পণ্য হয়ে উঠেছে মানুষের নিত্য ব্যবহার্য প্যান্ট আর টি-শার্ট। কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগে যেমন এগিয়ে তেমনি রপ্তানি খাতকেও সামনে থেকে পথ দেখাচ্ছে এ দুটি পণ্য।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের রপ্তানি বন্ধ্যত্ব কাটিয়ে এবার দেশের প্রধান দুই রপ্তানি পণ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.৬১ শতাংশ। এই এক বছরে প্যান্ট ও টি-শার্ট রপ্তানি বেড়েছে ৭৯৩ মিলিয়ন ডলার বা ছয় হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। কমপ্লাইয়েন্সড কারখানা, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজার চাঙ্গা হওয়ার পাশাপাশি অপ্রচলিত বাজারগুলো আবার সচল হওয়ার প্রভাব পড়েছে প্যান্ট ও টি-শার্ট রপ্তানিতে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে প্যান্ট রপ্তানি করে ছয় দশমিক ৩৮৯ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা (ডলার ৮৪ টাকা হিসেবে)। যা আগের অর্থবছরে রপ্তানি ৬ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি। গতবারের মন্দাভাব কাটিয়ে টি-শার্ট রপ্তানিও বেড়েছে ৭.৩৪ শতাংশ। সমাপ্ত অর্থবছরে টি-শার্ট রপ্তানি হয়েছে ৬ দশমিক ২৯২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪৩০ মিলিয়ন ডলার বা তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা বেশি।
দেশের তৃতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য হিসেবে যথারীতি নিজের অবস্থান অটুট রেখেছে জ্যাকেট। আগের অর্থবছরে রপ্তানি হওয়া ৩ দশমিক ৫৪৬ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে গত অর্থবছরে জ্যাকেট রপ্তানি হয়েছে ৩ দশমিক ৯৭৮ বিলিয়ন ডলার। এ খাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশের বেশি। জাতীয় রপ্তানিতে এর পরেই আছে সোয়েটার। সোয়েটার রপ্তানি করে গত অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩১৩ মিলিয়ন ডলার বেশি।
তবে টানা দ্বিতীয় বছরের মতো মন্দাভাব অব্যাহত আছে শার্ট রপ্তানিতে। সমাপ্ত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে শার্ট রপ্তানি হয়েছে ২ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলারের। আগের অর্থবছরে একই সময়ে ৪৪ মিলিয়ন ডলার কম।
ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধিতে থাকা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়ায়। এ সময় এককভাবে দেশের দুই প্রধান রপ্তানিপণ্য প্যান্ট ও টি-শার্টের রপ্তানি ৪.৪১ শতাংশ কমে যায়। তৈরি পোশাক খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, মূলত প্যান্ট ও টি-শার্ট রপ্তানিতে ধস নামার প্রভাব পড়েছিল জাতীয় রপ্তানিতে। তবে সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের হিসাবে, সেই প্যান্ট ও টি-শার্টের বাজার আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
প্যান্ট রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে প্যান্ট নিচ্ছে গ্যাপ, মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার, জারা, এইচঅ্যান্ডএম, সিঅ্যান্ডএ, চার্লস ভোগলে, র্যাংলার, আমেরিকান ইগল, মিলার, ডকার্স, ওয়ালমার্ট, টম টেইলর ও ওল্ডনেভির মতো বিশ্বমানের ব্র্যান্ডগুলো। ইপিবিতে নিবন্ধিত দেশের ২৮০টি ফ্যাক্টরি থেকে এই পণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানীকৃত প্যান্টের প্রধান বাজার ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র। ২০১২ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ছেলেদের প্যান্টের বাজার বাংলাদেশের দখলে। এর আগে এই বাজারটির দখল ছিল মেক্সিকোর কাছে। ফলে আর্থিক মূল্যেও যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ প্যান্ট রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে। চীন, ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোকে পেছনে ফেলে শীর্ষে উঠে আসে বাংলাদেশ।
এ ছাড়া সস্তাশ্রম আর কম উৎপাদন খরচের কারণে এইচঅ্যান্ডএম, গ্যাপ, নেক্সট, ম্যাটালন, নিউওয়েভ, ওয়ালমার্ট, জারার মতো বিশ্বখ্যাত চেনশপগুলো যেমন আছে তেমনি বিশ্বের নামি পোশাক ব্র্যান্ড জর্জিও আরমানি, হুগো বস, টমি হিলফিগার, বেন হিউসেন ও কেলভিন ক্লেইনও বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক টি-শার্ট আমদানি করে।
বিজিএমইএ পরিচালক ও দেশের বৃহত্তম ডেনিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘মান বিবেচনা করলে আমরা এখনো লো-মিডিয়াম ও মিডিয়াম মানের ডেনিম উৎপাদন করছি। সবই মূলত বেসিক প্রডাক্ট। ফ্যাশন ও প্রিমিয়াম প্রডাক্ট কম।’ তবে প্যাসিফিক জিন্সের নিজস্ব ডিজাইন করা প্রডাক্ট দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের রপ্তানি ভবিষ্যতের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বর্তমানে যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে তা যদি আরো কিছুদিন অব্যাহত থাকে তবে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ লাভবান হবে। কারণ ট্রাম্প সরকার চীনা পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক বসালে স্বাভাবিকভাবে আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলোর একটি বড় অংশ বাংলাদেশমুখী হবে।’
এ্যাবা গ্রুপের মালিকানাধীন গাজীপুরের ভিনটেজ ডেনিম অ্যাপারেলস লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জিন্স প্যান্টের ডিজাইন আসলে এর ওয়াশিং কোয়ালিটির ওপর নির্ভর করে। কোন মানের ওয়াশ হচ্ছে তার ওপর জিন্সটির ভ্যালু অ্যাডেড হয়। বাংলাদেশে এখন অনেক ভালো মানের জিন্স প্যান্ট তৈরি হয়। আমরা এখন ইউরোপে ডেনিম রপ্তানিতে প্রথম অবস্থানে আছি। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ৩ নম্বর পজিশনে থাকলেও অচিরেই এই বাজারে আমাদের অবস্থান আরো সুসংহত হবে।’