ডেনিম (সংগৃহীত)বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক পণ্য ডেনিম বা জিন্সের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন ব্র্যান্ড। বাংলাদেশের ডেনিম পশ্চিমা বিশ্বে বেশ গ্রহণযোগ্য। বলা যায়, বাংলাদেশের ডেনিমই এখন বিশ্বসেরা। জনপ্রিয়তার বিচারে ডেনিমকে ‘জিন্স’ নামেই বেশি চেনেন ব্যবহারকারীরা। তুলা ও বুননের বিশেষত্বের সুবাদে ‘ডেনিম’ বানানো হলেও এবার পাট ও সুতার মিশ্রণে তৈরি হবে এটি। এবারই প্রথম সুতার সঙ্গে পাটের আঁশ যুক্ত করে তৈরি হবে ডেনিম। পাটের তৈরি ডেনিম উৎপাদন শুরু হলে বিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশ আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশা।
পাটের আঁশ ও সুতা দিয়ে ডেনিম বা জিন্স তৈরির লক্ষ্যে স্পেশালাইজড জুট টেক্সটাইল মিল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলায় বাস্তবায়িত হবে ‘শেখ হাসিনা স্পেশালাইজড জুট টেক্সটাইল মিল’ নামের প্রকল্পটি। এর উদ্যোক্তা বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে বিজেএমসিকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমের সভাপতিত্বে ২০১৬ সালের ২১ জুলাই অনুষ্ঠিত সভায় বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন জুট মিলে বহুমুখী পাট পণ্য উৎপাদনের জন্য পৃথক ইউনিট স্থাপনের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
উদ্যোগী মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের বিষয়ে ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নীতিগতভাবে অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। সেই অনুযায়ী প্রণীত ডিপিপি পিইসি সভায় অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়। পিইসি সভার সুপরিশগুলোর আলোকে ডিপিপি পুনর্গঠন করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।
গত ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। মোট ৫১৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন (বিজেএমসি)। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দেওয়া অর্থে ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে এর কাজ শেষ হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বছরে ৪ লাখ ৩২ হাজার ডজন ডেনিম প্যান্ট প্রস্তুত করে বাংলাদেশ থেকে রফতানি করা যাবে। একইসঙ্গে দেশীয় শিল্প থেকে ২১ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ডেনিম ও অন্যান্য পাটজাত কাপড় সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পাটের তৈরি ডেনিমে শুধু প্যান্টই নয়, বানানো যাবে কোটও। যা হবে খুবই আরামদায়ক। দামেও হবে অনেক সস্তা।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক তন্তু হলো পাট। প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট বাংলাদেশে প্রচুর পাট উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। পাট মূলত বহুমুখী ও পুনঃব্যবহার উপযোগী, টেকসই, দূষণমুক্ত, পচনশীল, নিরাপদ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত এবং পরিবেশবান্ধব তন্তু। এজন্য অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাজারে দিনে দিনে বহুমুখী পাট পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। ফলে বহুমুখী পাটজাত পণ্য রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ‘শেখ হাসিনা স্পেশালাইজড জুট টেক্সটাইল মিল’ প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন করা হবে মাদারগঞ্জ উপজেলার ৮৫ হাজার ৬৪১ দশমিক ৪৬ ঘনমিটার ভূমি। সেখানকার ২০ হাজার বর্গমিটার জমিতে কারখানা গড়ে উঠবে। ১ হাজার ৫০০ বর্গমিটার জমিতে নির্মাণ করা হবে অফিস ভবন। অন্যান্য ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে ১৩ হাজার ১৮৯ দশমিক ৫৪ বর্গমিটার জমিতে।
বস্ত্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালক (পিডি) খুঁজছেন মির্জা আজম। আস্থা ও ভরসা না থাকায় বিজেএমসিকে বাদ দিয়ে অন্য কোনও স্থান থেকে একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সৎ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিতে চান তিনি। জানা গেছে, আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও এনভয় ডেনিমের কর্ণধার আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘ডেনিম পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক। বিশ্ববাজারে ডেনিমের চাহিদা ব্যাপক আর প্রবৃদ্ধিও ভালো। এটিকে এগিয়ে নিতে পারলে রফতানিতে বিশাল ভূমিকা পালন করবে ডেনিম। আর পাটের তৈরি ডেনিম বাংলাদেশকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেবে।’
জানা যায়, পাট ও তুলার সংমিশ্রণে সাশ্রয়ী মূল্যে সুতা, কাপড় ও তৈরি পোশাক (বিশেষভাবে ডেনিম প্যান্ট, জ্যাকেট, শার্ট) ইত্যাদি তৈরি ও বিক্রি করে অতিরিক্ত রফতানির মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের জন্য তিন স্তরের জিএসপি সুবিধা আদায় করার লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব সুতা ও কাপড় উৎপাদন করা প্রয়োজন।
এছাড়া রফতানি আয় বাড়ানোর জন্য ডেনিম উৎপাদনের পর অতিরিক্ত সুতা দিয়ে গৃহস্থালি ব্যবহার্য বিভিন্ন বস্ত্র ও মালামাল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের। এসব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং বহুমুখী পণ্য উৎপাদন ও রফতানি করে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ভিশন-২০২১ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ইউরো স্টেটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪ হাজার ৬৫১ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য আমদানি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৭৬ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য রফতানি হয়েছে।
ইউরোপের বাজারে ২০১০ সালে ৪৪৪ মিলিয়ন, ২০১১ সালে ৫৯১ মিলিয়ন, ২০১২ সালে ৭২৫ মিলিয়ন, ২০১৩ সালে ৮০৮ মিলিয়ন, ২০১৪ সালে ৯৩৯ মিলিয়ন, ২০১৫ সালে ১ হাজার ৩৫ মিলিয়ন, ২০১৬ সালে ১ হাজার ২২৭ মিলিয়ন ও ২০১৭ সালে ১ হাজার ৩২০ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য রফতানি হয়েছে।
ইউরো স্টেটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি ডেনিমের সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। যুক্তরাষ্ট্রের ৭০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত ডেনিম পণ্য ব্যবহার করে। ইউরোপে বাংলাদেশি ডেনিমের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি হলো যুক্তরাজ্য। সেখানে জনপ্রতি গড়ে ১৭টি ডেনিম পণ্য ব্যবহার হয়ে থাকে।