রফতানি তালিকায় দেশের পণ্যের সংখ্যা এখন ৭২০টি। তালিকা দীর্ঘ হলেও গত ২৫ বছরে রফতানি খাত তৈরি পোশাকনির্ভর। মোট আয়ের ৮৮ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। এ নির্ভরতা বাড়ছে দিন দিন। রফতানি প্রবণতা বলছে, আগামীতে এ হার এবং নির্ভরতা আরও বাড়বে। আবার পোশাক খাতেও আইটেমের বৈচিত্র্য সংকট রয়েছে। ঘুরেফিরে কম দামের গতানুগতিক টি-শার্ট, ট্রাউজারসহ কয়েকটি আইটেমেই সীমাবদ্ধ। এসব পণ্যের দর ও চাহিদা কম হওয়ায় পরিমাণে বেশি রফতানি সত্ত্বেও আয় আসছে কম। এ অবস্থায় বিভিন্ন কাজে ব্যবহূত বিশেষ ধরনের তৈরি পোশাক (ফাংশনাল আরএমজি) উৎপাদনের মাধ্যমে বৈচিত্র্য আনা যেতে পারে। ফাংশনাল আরএমজির ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের হিস্যা এখনও শূন্য। উদ্যোক্তারাও নতুন ধরনের এ পণ্যে বড় সুযোগ দেখছেন। তবে বিশেষায়িত পণ্য উৎপাদনে কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বলছেন তারা।
ফাংশনাল আরএমজি বলতে সাধারণত ফ্যাশন পণ্যের বাইরে বিভিন্ন কাজের উপযোগী পোশাকপণ্যকে বোঝানো হয়। যেমন- বুলেটপ্রুফ পোশাক, সামরিক বাহিনীর জন্য বিশেষ পোশাক, মহাকাশ অভিযানে নভোচারীদের পোশাক ইত্যাদি। এ ছাড়া স্বয়ংক্রিয় তাপ নিয়ন্ত্রণযোগ্য পোশাক, মেডিকেলে ব্যবহূত কাপড়জাতীয় উপকরণ, ফুটবল ও জুতা। এসব পণ্যের বড় অঙ্কের বাজারে এখনও বাংলাদেশের কোনো অংশ নেই। জার্মানি, ইতালি, জাপান ও চীনই প্রধানত বিশেষায়িত এ ধরনের পণ্য উৎপাদন করে থাকে।
উচ্চমূল্যের ফাংশনাল আরএমজি উৎপাদনে কেন যাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা- জানতে চাইলে পোশাক খাতের বড় প্রতিষ্ঠান টেক্সওয়েভের এমডি আশিকুর রহমান তুহিন সমকালকে বলেন, দামি মেশিনারিজ এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন। উদ্যোক্তাদের মধ্যে এসব বিষয়ে ঘাটতি আছে। তার মতে, গত সাড়ে পাঁচ বছর কারখানা সংস্কারে পাঁচ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের পর বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করার সামর্থ্য আর বেশিরভাগ উদ্যোক্তার নেই। এ কারণে ফাংশনাল আরএমজি কেন, কোনো ধরনের উচ্চমূল্যের পোশাকে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
গত বছর জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে ফাংশনাল আরএমজি পণ্য, প্রযুক্তি ও কাঁচামাল প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। টেকনিক্যাল টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস প্রদর্শনী নামে ওই আয়োজনে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উদ্যোক্তা ও ভোক্তা প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। প্রদর্শনীতে ফাংশনাল আরএমজির বাজার সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কথাও এতে উঠে আসে। প্রদর্শনীতে ফাংশনাল আরএমজির ওপর কয়েকটি সেমিনারে এ বাজারের তথ্য জানানো হয়। তবে বাংলাদেশের পক্ষে কোনো উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ওই প্রদর্শনীতে অংশ নেয়নি। সংগঠন হিসেবে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে ওই প্রদর্শনীতে অংশ নেন সিনিয়র সহসভাপতি ফারুক হাসান। সমকালকে তিনি জানান, কম দামের প্রথাগত পণ্য থেকে বেশি দামের পোশাক পণ্য উৎপাদনের সুযোগ তারাও চান। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, প্রযুক্তি দুর্বলতা এবং উপকরণ ও বিনিয়োগ সংকট। এ কারণে বাংলাদেশ এখনও বিশেষ ধরনের ফাংশনাল আরএমজি উৎপাদনে যেতে পারছে না।
‘সেলাই থেকে সমৃদ্ধি’ শীর্ষক গত বছর ঢাকায় প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এখনও উচ্চমূল্যের পোশাকে সেভাবে যেতে পারেনি। কম দামের পোশাকই বেশি উৎপাদন করে থাকে বাংলাদেশ। উচ্চমূল্যের পোশাকে যাওয়া এবং চলমান সংস্কার শেষ করতে পারলে বাংলাদেশের পোশাকের রফতানি অন্তত ১০ শতাংশ বাড়তে পারে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়।
তৈরি পোশাকে বৈচিত্র্য সংকট প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান সমকালকে বলেন, ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা, গবেষণা এবং উদ্ভাবনার অভাব, দক্ষ শ্রমিকদের ঘাটতি, অপ্রতুল অবকাঠামোসহ অসংখ্য সংকটের বাস্তবতায় প্রচলিত পণ্যের বাইরে বহুমুখী পণ্যের বিষয়ে ভাবতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। তিনি বলেন, এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে গভীরভাবে মনোযোগ দিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের নীতি-সহায়তা দিতে হবে।