প্রায় চার দশক আগে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সূচনা হয়েছিল চট্টগ্রামে। তবে জমির অভাবসহ নানা কারণে এ শিল্পে চট্টগ্রামের অগ্রণী অবস্থান টিকে থাকেনি। দেশের শীর্ষ রফতানি খাতটিতে চট্টগ্রামের অংশ প্রায় দুই দশক ধরে ক্রমে কমছে। ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট পোশাক রফতানির এক-তৃতীয়াংশ হতো চট্টগ্রাম থেকে। ২০১৭ সালে রফতানির পরিমাণ নেমে এসেছে মাত্র ৭ শতাংশে। চট্টগ্রামে পোশাক খাতের সংকোচনের বিপরীতে আশা দেখাচ্ছে মিরসরাই ইকোনমিক জোন। পাশাপাশি শহরের বাইরে বিভিন্ন উপজেলায় কারখানা স্থাপন করছেন ব্যবসায়ীরা। এতে করে নতুন সম্ভাবনা দেখছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
১৯৭৯ সালে বন্দরনগরীর কালুরঘাটে নুরুল কাদেরের ‘দেশ গার্মেন্টস’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের যাত্রা হয়। ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম ইপিজেড প্রতিষ্ঠা নগরীতে পোশাক শিল্পে গতিসঞ্চার করে। তবে পরবর্তীতে নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে না ওঠা, শহরে পর্যাপ্ত জমির অভাবসহ নানামুখী সংকটে চট্টগ্রামে অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বিজেএমইএ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে কারখানার সংখ্যা ৬৭৬টি। এর মধ্যে চালু আছে ৩৯১টি। বন্ধ হয়ে গেছে ২৮৫টি। চালু থাকা ৩৯১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪১টি কাজ করছে সাব-কন্ট্রাক্টর বা উপঠিকাদার হিসেবে।
রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএর তথ্যমতে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ২৯ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে রফতানি হয়েছে ৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা মোট রফতানি অর্থমূল্যের ১৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ। যদিও ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে পোশাক খাতে ১৫০ কোটি ডলারের রফতানিতে চট্টগ্রামের অংশ ছিল ৫০ কোটি ডলার, যা মোট রফতানি মূল্যের ৩৩ শতাংশ।
বিজিএমইএর তথ্যমতে, গত তিন বছরে তৈরি পোশাক খাতের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা সম্প্রসারণে চট্টগ্রাম নগরীর বাইরে গিয়ে উৎপাদন শুরু করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কর্ণফুলীর খোয়াজনগরে বেলামি টেক্সটাইল, এটিপি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, হ্যারডস গার্মেন্টস, জিএসএল এক্সপোর্ট, বেঞ্চমার্ক অ্যাপারেল। বোয়ালখালীতে রিজেন্ট টেক্সটাইল, ফিগো ফ্যাশন। পটিয়ায় রয়েছে ওশান স্টেট লিমিটেড, আরেফিন টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড ও সিজারস অ্যাপারেল লিমিটেড। এছাড়া আরো কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নগরীর বাইরে কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনায় আছে বলে জানান সংগঠনটির কর্মকর্তারা।
আরেফিন টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (এইচআর অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স) পলাশ কে. নাথ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের মূল প্রতিষ্ঠান প্রথমে চট্টগ্রামের পটিয়ায়ই ছিল। ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নগরীর চকবাজারের একটি ভবনে কারখানা স্থানান্তর করা হয়েছিল; কিন্তু নানা জটিলতা, কর্মপরিবেশের মান বজায় রাখা ও বিদেশী ক্রেতাদের বিভিন্ন নিয়মকানুন মানতে গিয়ে চকবাজারের কারখানা বন্ধ করে আবারো পটিয়ায় চলে যেতে হয়েছে। সেখানে আমাদের কার্যক্রম নগরীর চেয়ে ভালোভাবে চলছে। এমনকি আমরা পটিয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমর্থন পাচ্ছি।’
পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রাম অঞ্চলে জমির মূল্য অনেক বেশি। কারখানাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত নয়। নগরীতে স্থান সংকট প্রবল। তাছাড়া রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশন বিপর্যয়ের পর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে চট্টগ্রামে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের পোশাক শিল্পের সূচনা যে চট্টগ্রামে, সেখানে কোনো গার্মেন্টস পল্লী গড়ে ওঠেনি। তাছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট, অবকাঠামো সমস্যার কারণে এ অঞ্চলের তৈরি পোশাক শিল্প অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। চট্টগ্রামে সূচনা হলেও ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পোশাক শিল্পের প্রসার হয়েছে অনেক বেশি। যদিও চট্টগ্রামে বন্দর থাকার সুবাদে এ অঞ্চলে কারখানা বেশি হওয়ার কথা ছিল।
স্থানীয় উদ্যোক্তারা জানান, মিরসরাইয়ে ইকোনমিক জোন কেন্দ্র করে এ শিল্পে নতুন জাগরণ ঘটতে পারে। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান নগরীর বাইরে কারখানা স্থানান্তর করায় এক্ষেত্রে নীতিগত প্রণোদনা, স্থানীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও পোশাক রফতানিতে চট্টগ্রামের অংশ বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
সূত্র জানায়, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে পোশাক শিল্পের জন্য ৫০০ একর জমি বরাদ্দ চেয়েছে বিজিএমইএ। এরই মধ্যে ৬৪টি প্রতিষ্ঠান ৩৫৫ একর জমির জন্য প্রথম কিস্তির টাকা জমা দিয়েছে। বাকি জমি নেয়ার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান আগ্রহী বলে জানা গেছে। ২০১৯ সালের মধ্যে বিজিএমইএকে এ জমি বুঝিয়ে দেয়ার কথা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টরস ফোরাম ও বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবু তৈয়ব বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী শিল্পাঞ্চল ছাড়া গার্মেন্টস কারখানা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না— এমন নিয়ম আছে। কিন্তু চট্টগ্রামের কোনো শিল্পাঞ্চল কিংবা ইপিজেডে জায়গা খালি নেই। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন ভবনে অংশীদারি ভিত্তিতে চলা গার্মেন্টসগুলো কমপ্লায়েন্সের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী শহরের বাইরে কারখানা স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করেছেন। মিরসরাই ইকোনমিক জোন সম্পর্কে তিনি বলেন, ইকোনমিক জোন ঘিরে চট্টগ্রামের তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন। কিন্তু সেখানে যে পরিমাণ শ্রমিকের প্রয়োজন, সেটা পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে আমি সন্দিহান। তাছাড়া চট্টগ্রামে সেভাবে কোনো উদ্যোক্তা গড়ে উঠছে না।
পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হঠাৎ বেতন বৃদ্ধির ফলে আমাদের সমস্যায় পড়তে হবে। আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় শ্রমিক কম দামেই পাই। এটা ছাড়া অন্য কোনো সুযোগ আমরা পাচ্ছি না। অন্যান্য দেশে একই খরচ। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ এ বাজারে অবস্থান তৈরিতে মরিয়া। অন্য দেশ নানা প্রণোদনা দিয়ে তাদের পণ্য বিক্রির চেষ্টা করছে। সেক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে পড়ছি।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামে কেডিএস, প্যাসিফিক জিন্স, এশিয়ান গ্রুপ, ফোর এইচ গ্রুপের মতো বড় কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরি পোশাক খাত টিকিয়ে রেখেছে। নানা নিয়মের বেড়াজালে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে টিকে থাকতে পারছে না। তাছাড়া পণ্য সরবরাহে বিলম্ব ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে বিদেশী ক্রেতাদের আগ্রহ হারাচ্ছে চট্টগ্রাম। এ খাতকে আরো গতিশীল করতে ছোট প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন তারা।