যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এখন বেশ জোরেশোরে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে। তাই বাড়তি খরচের হাত থেকে বাঁচতে মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান পোশাকের ক্রয়াদেশ দিতে বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে। চীনা পোশাকের ব্যবসা আসতে শুরু করায় ক্রয়াদেশ বাড়ছে দেশীয় কারখানায়।
রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তা নিশ্চিত করেছেন, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। নতুন নতুন ক্রেতা পোশাকের ক্রয়াদেশ নিয়ে আসছে। পুরোনো ক্রেতারাও আগের চেয়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্রয়াদেশ বাড়িয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আয় শিগগিরই বাড়বে।
গত জানুয়ারিতে সোলার প্যানেল আমদানিতে ৩০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার মধ্য দিয়ে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের সূচনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সোলার প্যানেল উৎপাদনে শীর্ষস্থানে আছে চীন। পরে ৬ জুলাই ট্রাম্প ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের চীনা পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। এর জবাবে চীনও একই রকম ব্যবস্থা নেয়। পরের মাসে উভয় দেশই ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানিতে পাল্টাপাল্টি ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।
সর্বশেষ গত মাসে ২০ হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের চীনা পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। আগামী বছরের শুরুর দিকে এই শুল্কহার বেড়ে ২৫ শতাংশ হতে পারে। হাতব্যাগ, চাল, কাপড়সহ প্রায় ছয় হাজার পণ্যের ওপর এই শুল্ক আরোপ হয়। এই সিদ্ধান্তের বিপরীতে ৬ হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের মার্কিন পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে চীন।
এদিকে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর পর দু-তিন মাস ধরে বাড়তি ক্রয়াদেশ নিয়ে বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে আসছে মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশন এত দিন হেমরিক্স ও এসকে গ্রুপ নামে দুটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের কাজ করত। ফাংশন ওয়্যার নামে নতুন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাজ পেয়েছে তারা। এ ছাড়া হেমরিক্স দীর্ঘদিন ধরে মাসে এক লাখ পিস টি-শার্টের ক্রয়াদেশ দিলেও সম্প্রতি তা বাড়িয়ে ১ লাখ ৩০ হাজার পিস করেছে।
এমবি নিট ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নতুন ক্রেতা কাজ করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। পুরোনো দুটি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানও ২৫-৩০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বাড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা মূলত বেসিক আইটেম বা সস্তা পোশাকের ব্যবসা চীন থেকে সরিয়ে আনছেন। আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা যদি কোনো সমস্যা না করেন, তাহলে দুই দেশের বাণিজ্যযুদ্ধ শেষ হলেও ক্রেতারা সহজে চলে যাবে না।’
প্রায়ই একই তথ্য দিলেন ক্ল্যাসিক ফ্যাশন কনসেপ্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল্লাহ আজিম। তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রয়াদেশ বাড়ছে। নতুন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইনকোয়ারি আসছে। পুরোনো ক্রেতাদের মধ্যে আগে যারা দেড় লাখ পিস পোশাক তৈরি করাত, তারা এখন তিন লাখ পিসের ক্রয়াদেশ দিচ্ছে।’
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একক বৃহৎ বাজার যুক্তরাষ্ট্র। রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই বাজারটিতে পোশাক রপ্তানি কমে যায়। দীর্ঘ ১৫ মাস পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই বাজারে পোশাক রপ্তানি ঘুরে দাঁড়ায়। গত আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) বাজারটিতে ৩৬৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে চীন। অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, চীন গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ২ হাজার ৭০৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের মোট পোশাক আমদানির ৩৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ১ হাজার ৭২৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ০৪ শতাংশ কম।
রপ্তানি আয় কমার সঙ্গে সঙ্গে চীনের বাজার হিস্যাও কমে ৩২ দশমিক ৯০ শতাংশে নেমেছে। ইউএস পলোর পোশাক তৈরি করে বাংলাদেশের জায়ান্ট গ্রুপ। বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কারখানাটিতে ইউএস পলো ক্রয়াদেশ ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে। জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প লাভবান হবে। ইতিমধ্যে বাড়তি ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করেছে।’
ফারুক হাসান বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের পর গত কয়েক বছরে আমাদের পোশাক কারখানাগুলোতে তিন ধরনের বিনিয়োগ হয়েছে। সে জন্য কর্মপরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন ও উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে। ফলে বাড়তি ক্রয়াদেশ নেওয়ার জন্য অনেক কারখানাই প্রস্তুত হয়ে আছে।’
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাণিজ্যযুদ্ধের সুবিধা আমরা একটু একটু করে পেতে শুরু করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান চীন থেকে তাদের ব্যবসা সরিয়ে নিয়ে আসছে। যেমন-আমার কারখানায় যুক্তরাষ্ট্রে যে ক্রেতার একটা স্টাইল গত পাঁচ বছর ধরে দুই লাখ পিস করছি, তারা এখন চার-পাঁচ লাখ পিসের ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে বাণিজ্যযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৪-৫ শতাংশ হিস্যা হারাতে পারে চীনের পোশাক রপ্তানিকারকেরা।’
বিজিএমইএর এই সহসভাপতি বলেন, কারখানাগুলোতে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের পোশাক উৎপাদনের ভরা মৌসুম। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বাজারটিতে পোশাক রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাবে।