তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের অর্জন বিশ্বব্যাপীই গর্বের। বার্ষিক ৩ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে এ খাতের রফতানি আয়। ১০ বছর আগেও যেখানে পোশাক রফতানি থেকে আসত ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। এ শিল্পের আকার ধারাবাহিকভাবে বড় হলেও শ্রমিকরা ভুগছেন রক্তস্বল্পতা ও অপুষ্টিতে। এ শিল্পের নারী শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে আইসিডিডিআর,বি দেখিয়েছে, এদের ৮০ শতাংশই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বড় এ শিল্প খাতে কর্মরত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। এর ৬৫ শতাংশ অর্থাৎ ২৬ লাখই নারী।
এ নারী শ্রমিকদের পুষ্টি পরিস্থিতি জানতে ঢাকা ও ময়মনসিংহের চারটি কারখানার ২ হাজার ৬০০ শ্রমিকের ওপর গবেষণাটি চালায় আইসিডিডিআর,বি। ফলাফলে দেখা যায়, ১৮-৪৯ বছর বয়সী ওই নারী শ্রমিকদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে আটজনই রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন।
রক্তস্বল্পতায় ভোগা এ শ্রমিকদের একজন আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার কর্মী রহিমা খাতুন। দুই সন্তান, স্বামী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে ভাড়া থাকেন দুই রুমের এক টিনশেড ঘরে। বেশির ভাগ দিনই কাজে যেতে হয় না খেয়ে। কাজ করতে হয় রাত ৮টা পর্যন্ত। কোনো কোনো দিন ১০টাও ছাড়িয়ে যায়। ইদানীং কাজ করতে করতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন রহিমা খাতুন। খুব বেশি ক্লান্ত হলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। এরপর আবার কাজ। মাসে চার-পাঁচদিন কারখানায় অনুপস্থিতও থাকতে হচ্ছে তাকে। এ অসুস্থতা নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে জানতে পারেন অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন তিনি।
রক্তস্বল্পতার পাশাপাশি অপুষ্টিজনিত অন্যান্য শারীরিক জটিলতায়ও ভুগছেন নারী পোশাক শ্রমিকরা। আইসিডিডিআর,বির গবেষণার ফল বলছে, কারখানায় দীর্ঘদিন কাজ করার এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে বিষণ্নতাসহ শারীরিক ও মানসিক নানা সমস্যা দেখা দেয়। এতে তাদের কাজের প্রতি মনোযোগ কমে যায়। কর্মস্থলে অনুপস্থিতিসহ উৎপাদনশীলতায় এর প্রভাব পড়ে।
গবেষণাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আইসিডিডিআর,বির সহকারী বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুত্তাকিনা হোসেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের গবেষণায় অংশ নেয়া শ্রমিকদের কারখানায় অনুপস্থিতির কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সময়ই তারা পারিবারিক সমস্যার কথা বলছেন। প্রকৃত সমস্যা সম্পর্কে অবগত না হওয়ায় দীর্ঘদিনেও অবস্থার উন্নতি হয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তস্বল্পতার একাধিক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে খাদ্যে আয়রনের অভাব, কৃমি, রক্তক্ষরণ, মাতৃদুগ্ধ পান করানো ও পেপটিক আলসার। জটিল রোগ ছাড়া একজন মানুষের এসব কারণে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শারমিন রুমি আলীম বণিক বার্তাকে বলেন, রক্তস্বল্পতায় ভুগলে মানুষ দ্রুত ক্লান্তিবোধ করে ও কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। এর প্রভাব পড়ে উৎপাদনশীলতায়। পোশাক খাতের নারী শ্রমিকরা যদি দীর্ঘমেয়াদি রক্তস্বল্পতায় ভোগে, তাহলে উৎপাদনশীলতার ওপর অবশ্যই তার প্রভাব পড়বে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে আগে চিহ্নিত করতে হবে নারী শ্রমিকরা আয়রন নাকি আমিষের ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। সে অনুযায়ী তাদের আয়রনসমৃদ্ধ ও প্রাণিজ আমিষ খাওয়াতে হবে।
পোশাক খাতের নারী শ্রমিকরা ব্যাপক মাত্রায় রক্তস্বল্পতায় ভুগলেও তাদের শ্রমের ওপর ভর করেই আরো বড় হচ্ছে শিল্পটি। গত অর্থবছরও শুধু পোশাক রফতানি থেকেই আয় হয়েছে ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলার। তার আগের অর্থবছর এসেছিল ২ হাজার ৮১৪ কোটি ডলার। এছাড়া পোশাক রফতানি থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর আয় ছিল ২ হাজার ৮০৯ কোটি ও ২০১৪-১৫ অর্থবছর ২ হাজার ৫৪৯ কোটি ডলার। যদিও ২০০৮-০৯ অর্থবছর পোশাক রফতানি বাবদ বাংলাদেশের আয় ছিল ১ হাজার ২৩৪ কোটি ডলার।
বৃহৎ এ শিল্পে কর্মরত বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের পুষ্টি নিশ্চিতে শিল্পমালিকদের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, সারা দেশেই পুষ্টিহীনতা রয়েছে। তৈরি পোশাক খাতের বাইরে রয়েছে দেশের মানুষের বড় একটা অংশ। বরং এ খাতে যারা কাজ করছেন তুলনামূলক ভালো রয়েছেন তারা। পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে এক সময় কর্মীদের দুপুরের খাবার সরবরাহ করা হতো। তাদের আপত্তির কারণে খাবারের বদলে এখন টাকা দেয়া হচ্ছে।
রক্তস্বল্পতার জন্য নারী শ্রমিকদের জীবনযাপনের পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসেরও ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন বিজিএমইএ সভাপতি। তিনি বলেন, আমাদের মেয়েরা গ্রাম থেকে আসা। ফলে উদ্যোগ সত্ত্বেও অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না তারা। আবার চার-পাঁচ বছর চাকরি করার পর তাদের অনেকেই গ্রামে চলে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রেও আমাদের করণীয় নেই। তবে এখন এসব ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। আমার মনে হয় না এ সমস্যা কেবল পোশাক শিল্পের।
পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের মাধ্যমে যে নারী পোশাক শ্রমিকদের রক্তস্বল্পতা সমস্যার সমাধান সম্ভব, তারও প্রমাণ মিলেছে আইসিডিডিআর,বির গবেষণায়। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত গবেষণার ফল বলছে, শুধু পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ফলে নারী শ্রমিকের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। পরোক্ষভাবে তা শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতায়ও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
কাঙ্ক্ষিত মজুরি না পাওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পোশাক খাতের নারী শ্রমিকরা চাহিদার সবটা পূরণ করতে পারেন না বলে জানান সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মজুরি প্রয়োজন অনুযায়ী না হওয়ায় গোটা পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে চাপের মধ্যে থাকতে হয় পোশাক শ্রমিকদের। এ কারণেও তারা নিজের পুষ্টির প্রতি মনোযোগী হওয়ার সুযোগ সেভাবে পান না। পুষ্টিহীনতা নিয়েই কাজ করতে হয় তাদের।
বাংলাদেশের নারী পোশাক শ্রমিকদের পুষ্টির মান উন্নয়নে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (জিএআইএন) ২০১৫-১৭ সাল পর্যন্ত একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ২০১৭ সালের জুনে শেষ হওয়া প্রকল্পটিতে গার্মেন্টসে কর্মরত নারী শ্রমিকদের মধ্যে পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল ও আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট বিতরণ এবং গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির দেয়া দুপুরের খাবারের মান উন্নয়নসহ পুষ্টিবিষয়ক আচরণ পরিবর্তনের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। গার্মেন্ট শ্রমিকদের পুষ্টির মান উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্পটির অবদান বাড়ানোর লক্ষ্যে পরীক্ষামূলক প্রকল্পটি সম্প্রসারণের জন্য ‘স্ট্রেনদেনিং ওয়ার্কার্স অ্যাকসেস টু পার্টিনেন্ট নিউট্রিশন অপরচুনিটিজ (স্বপ্ন)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে জিএআইএন।
সম্প্রতি প্রকল্পটির উদ্বোধনকালে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতির প্রাণ। এ শিল্পকে আরো এগিয়ে নিতে শ্রমিকদের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ও সুস্থতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে শ্রমিকদের আর্থিক সঙ্গতির বিষয়টি মালিক-শ্রমিকদের মাথায় রাখতে হবে। আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বল্প খরচে কীভাবে তাদের পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা যায়, সেটি ভাবতে হবে।
পুষ্টিহীনতা নিয়ে অতিরিক্ত সময় কাজও করতে হচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের। ওভারটাইম বা অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা নিয়ে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ শ্রমিক ১২ ঘণ্টা কাজ করে। ১০ ঘণ্টা কাজ করে ২৩ শতাংশ শ্রমিক। অতিরিক্ত সময় কাজে নিয়োজিত থাকার অন্যতম কারণ দুর্বল সরবরাহ ব্যবস্থা।