তৈরি পোশাক শিল্পের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে চামাড় শিল্প। সস্তা শ্রম, গুণগত মানসম্পন্ন চামড়ার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের নামকরা ব্র্যান্ডগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী সক্ষম হয়ে গড়ে উঠলে বাংলাদেশও চামড়া শিল্পে বিনিয়োগের হাবে পরিণত হতে পারে বলে উল্লেখ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। ‘ডেভলপিং দ্য লেদার ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এডিবি এমনটি উল্লেখ করেছে। এতে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনার দিকগুলো উঠে এসেছে।
এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ হতে গত বছর, ২০১৭ সালে চামড়াসংশ্লিষ্ট পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানির মাত্র সাড়ে তিন ভাগ। এই রপ্তানির পরিমাণ বিশ্ববাজারের মাত্র শূন্য দশমিক ৬ ভাগ। পরিমাণের দিক থেকে বিশ্ববাজারের মাত্র ৩ ভাগ যোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ। সম্ভাবনাময় এই রপ্তানি পণ্যটি কয়েকটি বাজার ঘিরে আটকে আছে। ২০১২ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশ বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালের হিসাবে বাংলাদেশ থেকে ৪৪ ধরনের পণ্য বিভিন্ন দেশের ৮৪টি গন্তব্যে রপ্তানি হয়েছে। একই সময়ে ভিয়েতনাম ৫৯ ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে ১২২টি গন্তব্যে। ভারত ৬৩ ধরনের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করেছে ১৯৬টি গন্তব্যে। অন্য দিকে, চীন ৬৫টি ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে ২০৯টি গন্তব্যে। তবে বাংলাদেশ প্রধান রপ্তানি বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। মূলত চামড়ার গুণগত মান ভালো হওয়ায় বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা বিশ্ববাজারে বাড়ছে। চামাড়া শিল্পে বাংলাদেশের মূল্য সংযোজন প্রায় ৮০ ভাগ হওয়ায় এই খাতে পশ্চাত্ শিল্পেও রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা। বিশেষ করে সস্তা শ্রমিকের কারণে এই শিল্পে তৈরি পোশাক শিল্পের মতোই রয়েছে সম্ভাবনা। বর্তমানে বাংলাদেশে পাদুকা শিল্পে জড়িত রয়েছে সাড়ে ৮ লাখ কর্মী। পাদুকা শিল্পে কর্মরত ৭০ ভাগ শ্রমিক নারী। তাই এখাতে বড় কর্মসংস্থানের সুযোগও রয়েছে।
সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে চামড়া শিল্পকে। তৈরি পোশাকের বাইরে ভিন্ন পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও রয়েছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানির আকার ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১৩ সালে চামাড়জাত পণ্যের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৭ সালে ১৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বে পাদুকার সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ববাজারের ২৪.৭ ভাগ পাদুকা আমদানি করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যার অর্ধেকের বেশি আসছে চীন থেকে।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ চামড়া শিল্পে বিনিয়োগের হাবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো ঝুঁকছে বাংলাদেশের দিকে। চীনা বাজারে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের উত্পাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় তারা একসময় পিছিয়ে যাবে। ব্র্যান্ডগুলোর কারখানা স্থানান্তর হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হতে পারে তাদের জন্য সম্ভাবনার দেশ। এজন্য ‘ভ্যালু চেইন’ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্পের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জগুলোও উঠে এসেছে। হাজারিবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর হলেও পূর্ণাঙ্গভাবে পরিশোধন ব্যবস্থা চালু করা যায়নি। ফলে সাভারের ধলেশ্বরী নদী দূষিত হচ্ছে। তা ছাড়া, ট্যানারি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েই গেছে। ট্যানারি শিল্পে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো- অর্থের সংস্থান। সেইসঙ্গে দক্ষ জনবলের সংকট এবং প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে। ছোট ও মাঝারি শিল্পে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে দুর্বলতা রয়েছে। কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে কারিগরি ব্যবহারে অদক্ষতা, পণ্যের মান উন্নয়ন এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়েছে।
উদ্যোক্তারা অনেকটাই হতাশ
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস এন্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সাবেক সভাপতি আবু তাহের ইত্তেফাককে বলেন, এত সম্ভাবনাময় একটি শিল্পের উদ্যোগগুলো অনেক ধীরে বাস্তবায়ন হচ্ছে। আমরা উদ্যোক্তারা অনেকটাই হতাশ। কারণ হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর হয়েছে দুই বছর হতে চলল। কিন্তু হাজারীবাগের উন্নয়ন পরিকল্পনা বস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগোচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকার চামড়াজাত পণ্যে রপ্তানিতে সহায়তা দিলেও কৃত্রিম চামড়া পণ্য রপ্তানিতে তেমন সুবিধা নেই। বিশ্ববাজারে চামড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃত্রিম চামড়ার পাদুকা শিল্পের বড় বাজার রয়েছে। পাদুকা শিল্পে এগোতে হলে সেখানেও উন্নতি করতে হবে। তিনি বলেন, এই শিল্পে দক্ষ শ্রমিক ছাড়াও প্রযুক্তি ব্যবহারের অনেক ঘাটতি রয়েছে। তা ছাড়া, উদ্যোক্তাদের অর্থের জোগানটাই এখন বড় সমস্যা। তাই এই খাতের উন্নতি করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে তার সময় উপযোগী বাস্তবায়নের পথে এগোতে হবে।