সরকার ঘোষিত মজুরি বাস্তবায়ন করতে গেলে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনকে (বিজেএমসি) লোকসান গুনতে হবে। কেননা নতুন মজুরি বাস্তবায়নের আর্থিক সামর্থ্য নেই বিজেএমসির অধীনস্থ পাটকলগুলোর। গতকাল পাটশিল্প নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল্স) উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘পাটশিল্পের বর্তমান অবস্থা, সংকট ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারটির আয়োজন করে বিল্স। প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান ভূইয়ার সভাপতিত্বে এবং যুগ্ম মহাসচিব ও নির্বাহী পরিচালক মো. জাফরুল হাসানের সঞ্চালনায় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিল্স উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য সহিদুল্লা চৌধুরী।
সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিজেএমসির সাবেক মহাপরিচালক ও বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহমদ খান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ, বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শহীদুল করিম, বিল্স উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য মো. আশরাফ হোসেন ও মেসবাহউদ্দিন আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান, ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সভাপতি খলিলুর রহমান, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, খুলনার পাটশ্রমিক নেতা মহিউদ্দীন আহমেদ, চট্টগ্রামের পাটশ্রমিক নেতা মাহবুবুল আলম, ডেমরার করিম জুট মিলের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা আবুল হোসেন, লতিফ বাওয়ানী জুট মিলের দেলোয়ার হোসেনসহ পাটশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি, বিলেসর সহযোগী ও স্কপভুক্ত জাতীয় ফেডারেশন এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলের ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা।
মূল প্রবন্ধে বিল্স উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য সহিদুল্লা চৌধুরী দেশের পাটশিল্পের বর্তমান চিত্র উপস্থাপন করেন। এ সময় তিনি পাটশিল্পের জন্য করণীয় প্রসঙ্গে বলেন, প্রধানমন্ত্রী পাটশিল্পকে কৃষিভিত্তিক শিল্প ঘোষণা করেছেন। ফলে অন্যান্য শিল্পের মতো পাটশিল্পও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার দাবি রাখে। বিজেএমসির বর্তমান উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ বিক্রি ও বৈদেশিক রফতানি আয়ের পরিমাণের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংস্কার সাপেক্ষে অভিজ্ঞ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের নিয়ে মূল কাঠামো পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। চালু কারখানাগুলোতেও কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। বিজেএমসি অধীনস্থ মিলগুলোর নতুন মজুরি বাস্তবায়নের আর্থিক সামর্থ্য নেই। এক্ষেত্রে এনাম কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে নতুন মেশিনারিজের ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।
মূল প্রবন্ধে আরো বলা হয়, ভারত বাংলাদেশের পাটপণ্যের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক নীতি গ্রহণ করেছে। বর্তমানে ভারতে পাটপণ্য রফতানির বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকার ও মালিকপক্ষকে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু দেশে ৫০ হাজার টন পাটপণ্য রফতানি বন্ধ হয়ে গেছে। এটি চালু করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। ৫০ বছর ধরে গতানুগতিকভাবে হেসিয়ান, স্যাকিং ও সিবিসি তৈরি করা হচ্ছে। বিশ্ববাজারের কথা মাথায় রেখে এর মান উন্নত করতে হবে। প্রতি বছর ৭৫ লাখ বেল কাঁচাপাট উৎপাদিত হয়। দেশীয় শিল্পে ব্যবহূত হয় ৬১ লাখ বেল। বাকি ১৪ লাখ বেল বিদেশে রফতানি হয়। এক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে হলেও আরোপ ১০ লাখ বেল উন্নত জাতের পাট উৎপাদন করতে হবে।
সহিদুল্লা চৌধুরী বলেন, সরকার ১৮টি পাটকলের আধুনিকায়নে ৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। ১৮টি মিলের একসঙ্গে আধুনিকায়নের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। বরং পাঁচটি মিলকে দিয়ে কাজ শুরু করে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ধাপে ধাপে আধুনিকায়ন করতে হবে। গবেষণার সক্ষমতা ও বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করতে হবে। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও পাটপণ্যের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রাধান্য চলে এসেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে শতকোটি ডলার রফতানি হয়েছে। এ শিল্পে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ২০২১ সালের মধ্যে দ্বিগুণ করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় নিয়ে আমাদের সাশ্রয়ী মূল্যে পাটপণ্য উৎপাদন করতে হবে। ভারতের তুলনায় আমাদের পাটপণ্যের রফতানি গত ছয় বছরে বেড়েছে। এ অগ্রগতি বিবেচনায় নিয়ে বাজারমূল্য সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। পুরনো কারখানাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সঠিক পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এজন্য বিএমআরই থেকে আমাদের সরে আসতে হবে ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কারখানা নির্বাচন করতে হবে। সরকার ঘোষিত মজুরি বাস্তবায়ন করতে গেলে দ্বিগুণ বেতন দিতে হবে। এতে বিজেএমসিকে আবার লোকসান গুনতে হবে। এ কারণে বিষয়টি পর্যালোচনা করে শ্রমিক অধিকার বজায় রেখে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করতে পারলে দ্বিগুণ মজুরি দেয়া সম্ভব হতে পারে। মৃতপ্রায় কারখানার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য বড় ধরনের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, বিজেএমসিতেও ভারসাম্য বিবেচনা করে মানবসম্পদের আকার কমাতে হবে। করপোরেশনের অধীনস্থ কারখানাগুলোর ঋণের বোঝা কমানোর পরামর্শ দেন তিনি। এছাড়া তিনি কাঁচাপাট কেনার ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি রয়েছে, তা অবিলম্বে দূর করার আহ্বান জানান।
ড. মোবারক আহমদ খান বলেন, বাংলাদেশে পাটকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয় বলে এ দেশে পাট-সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় রয়েছে। পলিথিনের কুপ্রভাব বুঝতে পেরেছে বলেই বিশ্ববাজার এখন পলিথিন থেকে সরে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। এক্ষেত্রে সিনথেটিকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পাটের টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও পণ্যের মানোন্নয়নে পর্যাপ্ত গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সরকারকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি আরো বলেন, লিগনিন ও সেলুলোজের মতো পাটের উপজাতগুলোর অর্থনৈতিক ব্যবহারেও এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গার্মেন্টস শিল্পেও এর উপজাত ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে।
শহীদুল করিম বলেন, পাটপণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা মিলগুলোয় উৎপাদন মূল্য বেশি হওয়ায় তা স্থানীয় বাজার ধরতে পারছে না। সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার দেশের অভ্যন্তরে একটি বাজার তৈরি করতে চাচ্ছে। একে সম্ভাবনাময় করে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে বন্ধ মিলগুলোর বাস্তবতাও বুঝতে হবে। এক্ষেত্রে দেনা, আর্থিক ক্ষতি, মজুদ, বকেয়াসহ অন্যান্য অনুষঙ্গ বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিজেএমসির আওতাধীনসহ অন্যান্য বন্ধ পাটকলে নতুন কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিল্স উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য মো. আশরাফ হোসেন বলেন, পাটশিল্পে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এর ক্রমাগত অবনতি হয়েছে। এক্ষেত্রে শ্রমিকের অস্তিত্ব ও অধিকারের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।