পোশাক খাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসায়িক কাঠামো স্থাপন করা গেলে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানই সমান লাভবান হবে। ইমপ্যাক্ট মেজারমেন্টের মাধ্যমে সাপ্লাই চেইন পলিসির ফাঁকফোকরগুলো চিহ্নিত ও সেগুলো দূর করতে হবে। এমনটি করা গেলে সবাই উপকৃত হবে। গতকাল ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) ও দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন (এইচএসবিসি) বাংলাদেশ আয়োজিত ‘লিভারেজিং সাসটেইনেবল সাপ্লাই চেইন ইন অ্যাপারেল’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
ইউএনডিপির বিজনেস কল ফর অ্যাকশন প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে রাজধানীর একটি হোটেলে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসায়িক কাঠামো বাস্তবায়নে টেকসই সাপ্লাই চেইনের গুরুত্ব সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের অবহিত করার লক্ষ্যে এটি আয়োজিত হয়।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, পোশাক শিল্পকে টেকসই করার জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে। ভোক্তাদের আস্থা সুদৃঢ় করতে হবে। এর জন্য বাংলাদেশের পোশাকের রি-ব্র্যান্ডিং করা দরকার। এছাড়া বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতাও বাড়ানো প্রয়োজন।
গতকালের সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ। তিনি একটি প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে পোশাক কারখানা স্থাপনের জন্য বিজিএমইএকে ৫০০ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আরো ৫০০ একর জমি রিজার্ভ রয়েছে। সেখানে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারেন। তিনি জানান, পোশাক খাতে পশ্চাত্মুখী শিল্পকে শক্তিশালী করার জন্য আফ্রিকা থেকে তুলা আমদানির চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
আবুল কালাম আজাদ আরো বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের আলাদা পরিকল্পনা রয়েছে। সে অনুযায়ী পৃথক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও বেসরকারি খাত নিজেদের মতো করে কাজ করছে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ফ্রাঁসোয়া ডি ম্যারিকো। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশ। এজন্য দেশটিকে টেকসই সাপ্লাই চেইন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতেও সাহায্য করবে।
সেমিনারে উল্লেখ করা হয়, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ও পরিবেশগত বিভিন্ন ক্ষতির জন্য অপরিকল্পিত সাপ্লাই চেইন অনেকাংশে দায়ী। পরিবেশের এ ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলা করে প্রতিষ্ঠানগুলো যেন তাদের পণ্য ও সেবার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে, সে লক্ষ্যেই ইউএনডিপি ও এইচএসবিসি যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করেছে।
অনুষ্ঠানে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসায়িক কাঠামোর গুরুত্ব তুলে ধরেন ইউএনডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর সুদীপ্ত মুখার্জী। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে বড় বা ছোট— যেকোনো প্রতিষ্ঠানই সমভাবে লাভবান হয়। আমি আনন্দিত, এইচএসবিসি ও ইউএনডিপি এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে একটি ইকোসিস্টেম তৈরির প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। তাদের এ প্রয়াস টেকসই সাপ্লাই চেইনের ফাঁকফোকরগুলো দূরীকরণে সহায়তা করবে।
সেমিনারে কি-নোট উপস্থাপন করেন ইউএনডিপি ইনোভেশন হাবের প্রজেক্ট ম্যানেজার লিন্ডা জার্মানিস। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেকগুলো পরিবেশবান্ধব কারখানা হয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কারখানায় এখনো বর্জ্য পরিশোধনাগার নেই। ব্যবসা টেকসই করার ক্ষেত্রে এটি একটি চ্যালেঞ্জ। তিনি আরো বলেন, পোশাক ব্যবসা টেকসই করার জন্য নকশায় নতুনত্ব আনা জরুরি।
এইচএসবিসি ব্যাংকের ডেপুটি সিইও ও কান্ট্রি হেড অব হোলসেল ব্যাংকিং মো. মাহবুবুর রহমানের সঞ্চালনায় সেমিনারের প্রথম প্যানেল আলোচনায় অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসায়িক কাঠামোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়। এতে অংশ নেন বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ডেলিগেশনের প্রধান রেনসে তিরিঙ্ক। তিনি বলেন, ইইউ ৪০টি স্বল্পোন্নত দেশকে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা দেয়। বাংলাদেশ এ সুবিধার ৬০ শতাংশ ভোগ করছে। তিনি আরো বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ব্যবসা টেকসই করতে বাংলাদেশের উচিত এ অগ্রগতি তুলে ধরে তাদের পোশাকের রি-ব্র্যান্ডিং করা, যেন ভোক্তাদের মধ্যে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেবেল নিয়ে আস্থা তৈরি হয়। চ্যালেঞ্জিং হলেও বিষয়টি নিয়ে কাজ করা দরকার।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্র্যান্ড মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের (এমঅ্যান্ডএস) কান্ট্রি ডিরেক্টর স্বপ্না ভৌমিক বলেন, বিশ্বের যেসব দেশ থেকে আমরা পোশাক কিনি, তার মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী। বাংলাদেশ থেকে ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যও নিচ্ছি আমরা। তিনি আরো বলেন, ব্যবসা টেকসই করার জন্য সমুদ্র ও বিমানবন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কারণ পোশাক উত্পাদনে বড় ধরনের সক্ষমতা থাকার পরও সরবরাহ ব্যবস্থা দুর্বল থাকলে ব্যবসা হবে না। ব্যবসাকে টেকসই করার জন্য সরবরাহকারী ও ব্র্যান্ড উভয়কেই দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
ইউএনডিপির অ্যাসিস্ট্যান্ট কান্ট্রি ডিরেক্টর শায়লা খানের সঞ্চালনায় দ্বিতীয় প্যানেল আলোচনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ। নিজেদের একটি কারখানার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ভালুকায় আমাদের ডেনিম কারখানায় আমরা সর্বোত্কৃষ্ট ব্যবস্থা রেখেছি। সেখানে সূর্যের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহারের পাশাপাশি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ২ হাজার ৮০০ শ্রমিকের জন্য রয়েছে আবাসনের ব্যবস্থা। তাদের প্রতিদিন দুপুরে ভর্তুকির মাধ্যমে খাবার দেয়া হচ্ছে।