ইউরোপের ২৮টি দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নে (্ইইউ) ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি)। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, পোশাক খাতের সংস্কারবিষয়ক ইউরোপের ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশের (অ্যাকর্ড) কার্যক্রমের মেয়াদ না বাড়ানোর জের ধরে ইইউ বাংলাদেশের জিএসপি বাতিল করার হুমকি দিচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে এ সপ্তাহে বাংলাদেশ সফরে আসছেন নেদারল্যান্ডসের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী সিগরিদ কাগ। তাঁর এ সফরকালে ইইউয়ে বাংলাদেশের জিএসপি বিষয়ে আলোচনা হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে অ্যাকর্ডের কার্যক্রম বন্ধ করার বিষয়টি সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উঠেছে। গত ২৩ অক্টোবর পার্লামেন্টের ইউরোপিয়ান ফ্রি অ্যালায়েন্স গ্রিন্স (ভার্টস/অ্যালি) দলের সদস্য জুডিথ সারগেনটিনি বিষয়টি ইউরোপীয় বাণিজ্য কমিশনের নজরে এনে জানতে চেয়েছেন, ইইউ বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধার বিষয়টি তদন্ত ও বাতিল করতে প্রস্তুত আছে কি না। ইইউ বাণিজ্য কমিশনার ওই প্রশ্নের জবাব এখনো দেননি।
তবে ঢাকায় কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অ্যাকর্ডের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ইইউর বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্ন তুলছেন ইইউ প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা বলছেন, আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ অ্যাকর্ডের কার্যক্রম নবায়ন করেনি। পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে বাংলাদেশে নিজস্ব পরিদর্শন ব্যবস্থার (রিমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল, সংক্ষেপে আরসিসি) কাছে পরিদর্শন কার্যক্রম হস্তান্তর করার জন্য সরকার অ্যাকর্ড ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্সকে আরো ছয় মাসের সময় দিয়েছে। এটি আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
কূটনৈতিক সূত্রে আরো জানা যায়, আরসিসির সক্ষমতা সৃষ্টির আগ পর্যন্ত অ্যাকর্ড এ দেশে কারখানা পরিদর্শন চালিয়ে যাক—এমনটিই চেয়েছিল ইইউ। এটি না হওয়ায় ইইউ প্রতিনিধিরা জিএসপি বাতিল করার হুমকি হিসেবে ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারের উদাহরণ দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, মানবাধিকার ইস্যুতে ইইউয়ে ভিয়েতনামের জিএসপি বাতিল হতে চলেছে। মিয়ানমারও এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা বাংলাদেশ পরিস্থিতিও মূল্যায়ন করতে দ্বিধা করবেন না। ইইউ শ্রম অধিকারকেও মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে।
জানা গেছে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য জুডিথ সারগেনটিনি অ্যাকর্ডের মেয়াদ নবায়ন না করতে বাংলাদেশের আদালতের সিদ্ধান্ত এবং সরকারের পক্ষ থেকে সেটি পালন করার বিষয়টিও পার্লামেন্টে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, অ্যাকর্ড ১৯২টি আন্তর্জাতিক পোশাক প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিক সংগঠনের পক্ষে বাংলাদেশে পোশাকশিল্প কারখানাগুলো পরিদর্শন করে আসছে। জুডিথ সারগেনটিনি জানান, অ্যাকর্ডের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার ফলে বাংলাদেশে কারখানা নিরাপত্তায় এ যাবৎ অর্জিত অগ্রগতি ও শ্রমিকদের সুরক্ষা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে বিশ্বাস করেন অনেক পর্যবেক্ষক ও অংশীদার। গত জুন মাসে ব্রাসেলসে বাংলাদেশ সাসটেইনেবিলিটি কম্প্যাক্ট বৈঠকে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিনিধিরা নিজস্ব পরিদর্শনব্যবস্থা গড়ার সক্ষমতা সৃষ্টির পাশাপাশি অ্যাকর্ডের সঙ্গে চুক্তির আওতায় পরিদর্শন অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। অ্যাকর্ডের সঙ্গে চুক্তি অব্যাহত রাখতে ইইউ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কী উদ্যোগ নিয়েছে তাও জানতে চেয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ওই সদস্য।
সম্প্রতি অ্যাকর্ড বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রাথমিক পরিদর্শন সম্পন্ন করা ২০টি পোশাক কারখানা তদারকির দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে। গত সপ্তাহে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ইইউ রাষ্ট্রদূত রেঞ্চা টিয়েরিংক বলেন, এ দেশে তৈরি পোশাক কারখানা এত সংস্কার হওয়ার পরও ইউরোপের ক্রেতা-ভোক্তারা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগ গ্রহণ করতে চায় না। এ জন্য তিনি বাংলাদেশকে তার পণ্যের বিষয়ে আরো ব্র্যান্ডিং করার পরামর্শ দেন।
‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (অস্ত্র ছাড়া সব কিছু) স্কিমের আওতায় বাংলাদেশ ইইউর বাজারে জিএসপির আওতায় সব পণ্যে (অস্ত্র ছাড়া) শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পেয়ে আসছে। একক অঞ্চল হিসেবে ইইউ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় গন্তব্য। জিএসপি প্রত্যাহার হলে ইইউয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধাক্কা খাবে।
এর আগে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত করেছিল। সে সময় ইইউর বাজারেও বাংলাদেশের জিএসপি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তখন সরকার তড়িঘড়ি করে ইইউর সঙ্গে সাসটেইনেবিলিটি কম্প্যাক্ট সই করে। এর আওতায় এ দেশে কারখানা ভবন নিরাপত্তা পরিদর্শনে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ২০১৩ সালের ১৫ মে পাঁচ বছর মেয়াদি অ্যাকর্ড সই হয়েছিল।