আজ ২৪ নভেম্বর। ছয় বছর আগে এ দিনে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের নিশ্চিন্তপুর এলাকার তাজরীন ফ্যাশন নামের পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ওই অগ্নিকা-ে ১১৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়; আহত হন আরও ৩ শতাধিক। অগ্নিকা-ের ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত অনেক শ্রমিকের অভিযোগ, এখনও তারা সরকার ও বিজিএমইএ ঘোষিত আর্থিক সহায়তা পাননি।
জানা যায়, ছয় বছর আগে এ দিনে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তোবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশন নামের পোশাক কারখানার নিচতলায় থাকা তুলার গুদামে আগুন লাগে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন নিচতলা থেকে পঞ্চমতলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বিভিন্ন ফ্লোরে থাকা প্রায় ১ হাজার শ্রমিক জীবন বাঁচাতে দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করেন। অনেকে ছাদ থেকে, জানালা দিয়ে লাফিয়ে বা ভবনের পাইপ বেয়ে জীবন বাঁচাতে পারলেও ১১৩ জন শ্রমিকের প্রাণ কেড়ে নেয় আগুন। অগ্নিদগ্ধ ও আহত হন আরও প্রায় ৩ শতাধিক শ্রমিক।
বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিন তাজরীন পোশাক কারখানায় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক আহত শ্রমিকই পোশাক কারখানার আশেপাশে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের চোখেমুখে কষ্টের ছাপ। আগুনে পোড়ার ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাজরীন পোশাক কারখানার সেই ভবনটি। প্রধান ফটকে তালা ঝুললেও ভেতরে রয়েছে কয়েকটি গরু। ভবনে রয়েছে নিরাপত্তাকর্মী। অনেক শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা দিনটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি নিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেক আহত শ্রমিকই চারপাশে গড়ে তুলেছে ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
ওই এলাকায় কথা হয়, আহত সাবিনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি তাজরীনে ফ্যাশনের ষষ্ঠতলায় সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। অগ্নিকা-ের সময় তিনি কারখানার ভেতরেই ছিলেন। আগুন লাগার পরপরই প্রাণে বাঁচার জন্য কারখানার চারতলার জানালা ভেঙে লাফিয়ে পড়েন। নিচে পড়ে গিয়ে বুক ও কোমরের হাড় ভেঙে যায় সাবিনার। এরপর থেকে আর কোনো পোশাক কারখানায় কাজ করাতো দূরে থাক নিজের সংসারের কাজও ঠিকমতো করতে পারেন না তিনি। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে সেলিম মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকেন সাবিনা। তাজরীনের আগুন তার জীবনের সব স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। নিজের ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে ভালোভাবে মানুষ করার স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। অগ্নিকা-ে আহত হওয়ার পর কোনো ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় গ্রামের জমি বিক্রি করে কোনো রকম চিকিৎসা করিয়েছেন। অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা তো দূরের কথা সামান্যতম চিকিৎসা সেবাটুকুও মেলেনি তার ভাগ্যে।
তাজরীনের আগুন থেকে প্রাণে বাঁচতে গিয়ে আরেক শ্রমিক রেহেনা বেগম ভবন থেকে লাফিয়ে নিচে পড়েন। তিনি ফিনিশিং শাখায় অপারেটরের কাজ করতেন। প্রাণে বাঁচলেও তার বাম পায়ে প্রচ- আঘাত লাগে। অগ্নিকা-ের পর বিজিএমইএ থেকে ১ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়। সহায়তার টাকা দিয়ে বেশ কিছু দিন চিকিৎসা করাতে পারলেও এখন নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। স্বামীও তাকে ছেড়ে দিয়ে আরেকটি বিয়ে করেছেন। গ্রামের জমি বিক্রি করে কোনো রকম বেঁচে আছেন। নিজের দুই সন্তান গ্রামের বাড়িতে তার ছোট বোনের কাছে থেকে পড়াশোনা করছে। তাদের পড়াশোনার খরচ তার ছোট বোনই বহন করে। তাজরীনের সেই অগ্নিকা- তার জীবন একেবারেই এলোমেলো করে দিয়েছে।
সাবিনা আর রেহেনা নন, আঞ্জুয়ারা, আলিনুর, হেনা আক্তার, জাইনুস আক্তারসহ অনেক শ্রমিক শরীরের ক্ষত চিহ্ন নিয়ে হাজির ভবনটির আশপাশে। তাদের ধারণা, এবার হয়তো কেউ তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে। তারা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ছয় বছর পার হলো এখনও কোনো ক্ষতিপূরণ পেলাম না, আর পাব কিনা তা-ও জানি না। একটু সুখের আশায় ঘর থেকে কারকানায় ঢুকেছি, আর সে কারখানাই গলাটিপে সুখকে ধ্বংস করে দুঃখ এনে দিয়েছে। এমন বাঁচার চেয়ে মরাটাই ভালো ছিল। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি তুহিন চৌধুরী বলেন, তথ্যগত কারণে কিছু শ্রমিক এখনও ক্ষতিপূরণ পাননি। তবে অনেকেই সরকারের ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসা পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তারা আবারও ধরেছে সুঁই-সুতা শুরু করেছে উৎপাদন।
নিহতদের স্মরণে মানববন্ধন : নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সাভারের আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকা-ের ছয় বছর পূর্তি উপলক্ষে নিহতদের স্মরণে গ্রিন বাংলা গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের উদ্যোগে শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করা হয়েছে। সংগঠনের সভাপতি সুলতানা বেগমের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন শ্রমিক-কর্মী ঐক্য পরিষদের জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ, কার্যকরী সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ, সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াস, যুগ্ম সম্পাদক খাদিজা রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ফরিদ উদ্দিন, সহ-সভাপতি সুইটি আক্তার প্রমুখ। অবিলম্বে নিহত শ্রমিক পরিবার ও আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসনসহ সব গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিতের দাবি জানান বক্তারা। বক্তারা বলেন, তাজরীন গার্মেন্টের অগ্নিকা-ের ছয় বছর পূর্ণ হলেও এখনও ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।