প্রতিনিয়ত উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, সে তুলনায় বাড়ছে না উৎপাদিত তৈরি পোশাকের দাম। সঙ্গে কমছে তৈরি পোশোকের চাহিদাও। এই তিন এ কারণে কমছে আয়। আর এই আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেটাতে না পেরে ক্রমশ বন্ধ হচ্ছে দেশের ছোট ও মাঝারি তৈরি পোশাক কারখানা। এভাবে চলতে থাকলে তৈরি পোশাক খাতে একসময় অন্ধকার নেমে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন দেশের ছোট ও মাঝারি সাইজের তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা। তবে এসব মন্তব্য মানতে নারাজ তৈরি পোশাক খাতের সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, রানা প্লাজা ধসের পর অনেকেই মনে করেছিলেন যে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প আর টিকবে না। কিন্তু এখনও যেহেতু এ খাত টিকে আছে সেহেতু আর কোনও দুঃসংবাদ আসবে না। এ খাতের ভবিষ্যৎ ভালো বলেও জানান তারা।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, গত চার বছরে দেশের তৈরি পোশাক খাতের বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমেছে ৮ শতাংশ। পণ্য উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের দর কমেছে গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ। এই তিন প্রতিকূলতায় বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের মুনাফা কমেছে।
সূত্র জানায়, গার্মেন্টস পণ্যের মুনাফা কমার এই তিন কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে আসে। গত অর্থবছরে তা আবার বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অথচ ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের বছরেও রফতানিতে প্রবৃদ্ধি এতটা কম ছিল না। ওই বছরের এপ্রিলের পর জুন পর্যন্ত তিন মাসের খারাপ সময় সত্ত্বেও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাকশিল্পে গত পাঁচ বছরে ১ হাজার ৯৬৫টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। চাকরি হারিয়েছেন কয়েক লাখ শ্রমিক। একই সময়ে সংকুচিত হয়েছে পোশাক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ। রানাপ্লাজা ধসের পর থেকে কম্প্লায়েন্সসহ নানা ইস্যুতে ছোট ও মাঝারি আকারের এসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ওপর আন্তর্জাতিক বাজারে কমছে পণ্যের দাম।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রানাপ্লাজা ধসের পর বিদেশে বাংলাদেশের পোশাক খাতবিরোধী প্রচারণা, ক্রেতাদের বিভিন্ন শর্তা আরোপ, চুক্তিতে অন্য কারখানায় কাজ করানোর সুযোগ কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্রমতে, বিজিএমইএর নিবন্ধিত তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ৬ হাজার ১৯৬টি। এর মধ্যে বিভিন্ন জটিলতায় বিজিএমইএ নিবন্ধন বাতিল করার কারণে ১ হাজার ৭৬৫টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এই সংখ্যা বাদ দিলে বিজিএমইএ’র নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪৩১টি। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের পরিদর্শনে চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয়েছে আরও ২০০টি। সর্বোপরি বর্তমানে সক্রিয় কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০টি।
সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রামে ২০১৩ সালে ১৪১টি, ২০১৪ সালে ২১২টি, ২০১৫ সালে ১৩৭টি, ২০১৬ সালে ১৩৫টি এবং ২০১৭ সালের চলতি এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৫৩টি কারখানার সদস্যপদ বাতিল করেছে বিজিএমইএ।
তৈরি পোশাক খাতের অপর একটি সূত্র জানায়, গত ৪ বছর ধরে পোশাক খাতের চলমান সংস্কার চাপে উৎপাদন থেকে ছিটকে পড়েছে তিন হাজারেরও বেশি কারখানা। এসব কারখানা এখন উৎপাদনে নেই। অনেক কারখানাই বন্ধ। এর মধ্যে বিজিএমইএ থেকে বাদ পড়েছে মোট এক হাজার ১৬৩টি কারখানা। বিকেএমইএ থেকে বাদ পড়া এবং সংস্কার চালাতে রাজি না হওয়া- এ দুই কারণে ৮০০ কারখানা এখন আর উৎপাদনে নেই। পোশাক খাতের সংস্কার বিষয়ক ইউরোপের ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড থেকে বাদ পড়েছে ১৪৪টি। অপর ক্রেতাজোট উত্তর আমেরিকার অ্যালায়েন্স থেকে বাদ পড়েছে ১৫৭টি কারখানা। অর্থাৎ সংস্কারে অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় দুই জোটের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ৩১১টি কারখানা। দুই ক্রেতা জোটের বাইরে অন্য ক্রেতাদের রফতানি আদেশ সরবরাহ করা হয় এ রকম এক হাজার ৮২৭টি কারখানার সংস্কার চলছে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের (ডিআইএফই) অধীনে।
ছোট ও মাঝারি সাইজের কারখানা বন্ধের পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কারখানা সংস্কারে অর্থ সহায়তা হিসেবে আইএফসি, জাইকাসহ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ সুদে ঋণদানে পৃথক একটি তহবিল করেছে। তহবিলের সহায়তা উদ্যোক্তাদের হাতে এসে পৌঁছাতে সুদ বেড়ে তা ৯ থেকে ১০ শতাংশে দাঁড়ায়। এ কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিচ্ছেন না। অন্যদিকে কারখানা সংস্কারে অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকেও আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা ছিল। তবে মেয়াদের শেষ মুহূর্তে এসে নামেমাত্র অর্থ সহায়তা দিয়েছে অ্যাকর্ড। বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে কয়েকটি কারখানাকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকে। এর বাইরে সরাসরি আর কোনও অর্থ সহায়তা দেয়নি ক্রেতারা। তাই কারখানাগুলোকে শর্ত অনুযায়ী সংস্কার করতে পারেনি অনেক কারখানা মালিক। শর্ত অনুযায়ী কারখানা সংস্কার করতে ব্যর্থ হওয়ায় কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন তারা।
বিজিএমইএ নেতারা জানান, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে ঠিকই, তবে সার্বিকভাবে দেশে পোশাক কারখানার সংখ্যা কমছে। কারণ যে হারে কারখানা বন্ধ হচ্ছে, সেই হারে নতুন কারখানা গড়ে উঠছে না। একইভাবে সাভারের রানাপ্লাজা ধসের পর থেকে বিদেশি খ্যাতনামা ব্র্যান্ডের বড় ক্রেতারা অংশীদারি ভবনে অবস্থিত কারখানা থেকে পোশাক নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আগে বড় কারখানাগুলো বিপুল পরিমাণ রফতানি আদেশ সময়মতো সরবরাহ করতে অনেক ছোট ও মাঝারি কারখানাকে দিয়ে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করিয়ে নিতো। এখন ক্রেতারা সাব-কন্ট্রাক্টে চলা এসব কারখানার কর্মপরিবেশও আন্তর্জাতিক মানের কিনা তা যাচাই করছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে তৈরি পোশাক খাতের ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো হয়তো কিছু সমস্যা মোকাবিলা করছে। তবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার ভবিষ্যৎ যতো বলা হয় ততোটা খারাপ নয়। বাংলাদেশে ক্রমশই গ্রিন ফ্যাক্টরির সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে কমপ্লায়েন্স কারখানা। সেইসঙ্গে শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধাও বাড়ছে। যদি পরিস্থিতি খারাপই হতো তাহলে বিশ্বমানের কারখানা বাংলাদেশে এতো বাড়তো না।’ তবে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।