তৈরি পোশাক রফতানি খাতে আলোচিত ছিল পশ্চিমা দুই ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের নানা কর্মকাণ্ড। মেয়াদ শেষেও অধিককাল বাংলাদেশে থাকার ইচ্ছায় পশ্চিমা উন্নয়ন অংশীদারদের মাধ্যমে সরকারকে চাপে রাখা এবং বাংলাদেশ ছাড়তে উচ্চ আদালতের রায়- এমন অনেক কারণে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল ইউরোপের ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ বা অ্যাকর্ড। শ্রমিক অধিকার প্রশ্নে জোটটির কঠোর অবস্থান ও সংস্কারে পিছিয়ে থাকা তিন শতাধিক কারখানা থেকে পোশাক না নিতে ক্রেতাদের কাছে চিঠি দেওয়ার ঘটনা উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়ায়।
অন্যদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অপর ক্রেতা জোট উত্তর আমেরিকার অ্যালায়েন্সের কর্মকাণ্ড ততটা আলোচনার জন্ম না দিলেও তাদের মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা চলেছে ভেতরে ভেতরে। সেফটি মনিটরিং অর্গানাইজেশন (এসএমও) এবং একাধিক বিকল্প প্ল্যাটফর্ম গঠনের চেষ্টা করা হয়েছে জোটের পক্ষ থেকে। তবে শেষ পর্যন্ত বর্ধিত ছয় মাসের মেয়াদ শেষে ৩১ ডিসেম্বর কার্যক্রম গুটানোর ঘোষণা বাস্তবায়নে উদ্যোক্তা এবং সরকারের প্রশংসা পেয়েছে অ্যালায়েন্স।
দুই ক্রেতা জোটের বাইরেও শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) তত্ত্বাবধানে অসংগঠিত কারখানার সংস্কারে গতি বেড়েছে বিদায়ী বছরটিতে। গত কয়েক বছর ধরে অনুরোধ এবং সতর্ক করার পর বছরের শেষ দিকে এসে এ ব্যাপারে কঠোর হয় সরকার। সংস্কারে পিছিয়ে থাকা তিন শতাধিক কারখানার আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়ে অনুরোধ করে ডিআইএফই। তারা একই অনুরোধ করে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএকেও। দুই ক্রেতাজোটের মেয়াদ পরবর্তী সংস্কার চালিয়ে নিতে ডিআইএফইর নেতৃত্বে রেমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল (আরসিসি) গঠন করা হয় বছরের প্রথম দিকে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওর সহযোগিতায় পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্স। আরসিসির পূর্ণ সামর্থ্য বৃদ্ধির আগে কোনো কারখানা হস্তান্তর করতে রাজি ছিল না কোনো জোট। তবে বছরের শেষ দিকে এসে দুই কিস্তিতে ৮০টি কারখানা আরসিসির কাছে হস্তান্তর করেছে অ্যাকর্ড। তবে কৌশলে হস্ততান্তর এড়িয়ে গেছে অ্যালায়েন্স। অ্যালায়েন্সের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কারখানার মালিকানা অ্যালায়েন্সের ছিল না যে, তা হস্তান্তর করতে হবে।
এদিকে পোশাক রফতানিতে উচ্চহারের প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা উদ্যোক্তাদের মধ্যে বড় ধরনের স্বস্তি এনে দিয়েছে বিদায়ী বছরে। বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) রফতানি বাড়ে। বছরের বাকি ৬ মাসের মধ্যে ৫ মাসের রফতানি তথ্য পাওয়া গেছে। এই ৫ মাসে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ শতাংশ। প্রধান প্রধান সব বাজারে রফতানি বাড়ছে। ভারত, চীন, জাপানসহ অপ্রচলিত বাজারেও রফতানি বেড়েছে রেকর্ড হারে।
ধারাবাহিক এই উন্নতির নেপথ্যে রয়েছে পোশাক খাতে গত ৫ বছর ধরে সংস্কারে নিরাপত্তা উন্নয়নের সুফল। দুই ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের তত্ত্বাবধানে বিশাল ব্যয়ের সংস্কারের ফলে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে। সংস্কার এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর ফলে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া ক্রেতারা ফিরেছে। বছরের শেষ দিকে এসে চীন-মার্কিন বাণিজ্যে শুল্ক্ক লড়াই এই গতিতে নতুন শক্তি যুগিয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের মতে, বাংলাদেশের পোশাক খাত এখন বিশ্বের নিরাপদ কারখানার রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গত ৫ বছরে পোশাক খাতে ব্যয়বহুল যে সংস্কার অগ্রগতি, তাতে নতুন ক্রেতাদেরও দৃষ্টি কেড়েছে। বিশ্বব্যাপী নিরাপদ পোশাক কারখানার রোল মডেল হিসেবে মজবুত অবস্থানে থেকে একটা ভালো বছর পার করেছে পোশাক খাত। একই কারণে আগামীতেও উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে আশা করেন তিনি।
বিদায়ী বছরে চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ থেকেও কিছু সুবিধা পাওয়া পাওয়া গেছে। অন্যান্য পণ্যের মতো চীন তৈরি পোশাকের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন হারে শুল্ক্কারোপের কারণে অনেক মার্কিন ব্র্যান্ড এবং ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের পোশাকের প্রতি নতুন করে আগ্রহ দেখিয়েছে। অনেক নতুন ক্রেতা রফতানি আদেশ দিয়েছেন। পুরনো ব্র্যান্ড এবং ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও রফতানির পরিমাণ বাড়িয়েছে। বছরের প্রথম দিকের তুলনায় শেষ দিকে বেশি হারে রফতানি বৃদ্ধির পেছনে এটাও একটা বড় কারণ।