সদস্যদের ভোটে নয়, সমঝোতার ভিত্তিতে দুই বছরের জন্য পদ পেয়ে সাড়ে তিন বছর দায়িত্ব পালন করছেন। এমন ‘সাফল্য’ আগের কোনো সভাপতিই দেখাতে পারেননি। নতুন করে আবার ক্ষমতার মেয়াদ বাড়াতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। এই ‘তিনি’ হলেন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান।
জানা গেছে, বিজিএমইএর বর্তমান পর্ষদের বাড়তি মেয়াদ শেষ হবে আগামী মার্চে। এ জন্য ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন ও নির্বাচনী আপিল বোর্ড গঠন করার কথা। তবে সেটি না করে নতুন করে এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন সিদ্দিকুর রহমান। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তিনি আবেদনও করেছেন। এ ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের বৈঠক ডেকে অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা তিনি করেননি।
বিজিএমইএর একেকটি কমিটির মেয়াদ সাধারণত দুই বছর হয়। তবে বর্তমান সভাপতি নানা অজুহাত দেখিয়ে তাঁর পর্ষদের মেয়াদ ইতিমধ্যে দুই দফায় দেড় বছর বাড়িয়ে নিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আবারও আবেদন অনুযায়ী সময় বাড়ালে বর্তমান কমিটির মেয়াদ সাড়ে চার বছরে গিয়ে দাঁড়াবে। তখন সেটি দাঁড়াবে এক টিকিটে দুই মেয়াদের বেশি দায়িত্ব পালন।
বিজিএমইএর নেতৃত্ব নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুটি বড় পক্ষ—সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরাম। উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী, বিজিএমইএর পরবর্তী সভাপতি হবে ফোরাম থেকে। বর্তমান সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের মেয়াদ বৃদ্ধির তৎপরতা জানতে পেরে গত সপ্তাহে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের কাছে নালিশ জানান বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও ফোরাম নেতা আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ, মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হকসহ সাতজন। তাঁরা মন্ত্রীকে বলেন, সভাপতি নিজের মেয়াদ বাড়ানোর যে চেষ্টা করছেন, তা বিজিএমইএর সদস্যরা পছন্দ করছেন না।
ফোরামের নেতারা সর্বশেষ গত মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে তাঁদের আপত্তি জানান। তাঁরা চিঠিতে নতুন করে মেয়াদ বৃদ্ধি না করে বর্তমান পর্ষদকে অনতিবিলম্বে নির্বাচন ও আপিল বোর্ড গঠন করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার নির্দেশ দিতে মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেন।
জিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদনের কোনো সিদ্ধান্তই আমার নিজের নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মেয়াদ বাড়াবে কি না, দু–এক দিনের মধ্যে জানা যাবে।’
বিজিএমইএ যে মন্ত্রণালয়ে মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছে, সেটি নিশ্চিত হওয়া গেছে মন্ত্রণালয় থেকে। বাণিজ্যসচিব মফিজুল ইসলাম গতকাল বলেন, ‘বিজিএমইএর কমিটির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে একটি আবেদন এসেছে। সেটি প্রক্রিয়াধীন আছে।’
বর্তমান কমিটির মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে সম্মিলিত পরিষদের নেতা ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বিজিএমইএর সাবেক সভাপতিদের একটি ফোরাম আছে। ফলে সাবেক সভাপতিরা বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সবকিছুই নিয়মতান্ত্রিকভাবে হওয়া উচিত। নিয়মবহির্ভূত কিছু কেউ পছন্দ করে না।’
সম্মিলিত পরিষদের আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভোট না হওয়ায় পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে কোনো জবাবদিহি নেই। ফলে বিজিএমইএ ইচ্ছেমতো চলছে। তারই সর্বশেষ নমুনা হচ্ছে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন না নিয়েই নির্বাচন না করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তটি বেআইনি। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে বিব্রত।
সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে বিজিএমইএর বর্তমান কমিটি ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করে। ২০১৩ সালে সাধারণ সদস্যদের ভোটে সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন হলেও ২০১৫ সালে তা হয়নি। মূলত সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরামের নেতারা সমঝোতার ভিত্তিতে কমিটি করার সিদ্ধান্ত নেন। দুই মেয়াদের জন্য সেই সমঝোতা হয়েছিল।
সমঝোতা অনুযায়ী প্রথমবার সম্মিলিত পরিষদ সভাপতি, ৪ সহসভাপতিসহ ১৪ পরিচালক এবং ফোরাম তিন সহসভাপতিসহ ১৩ পরিচালক পদ পেয়েছে। পরের মেয়াদে সভাপতিসহ অন্য পদগুলো দুই পক্ষের মধ্যে অদলবদল হবে। উভয় পক্ষের শীর্ষ নেতারা সেই সংখ্যক প্রার্থী বাছাই করে মনোনয়নপত্র জমা দেন। সে জন্য আর নির্বাচনের প্রয়োজন পড়েনি।
বিজিএমইএর বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরে। তবে তার আগেই উত্তরায় নতুন ভবন নির্মাণকে পুঁজি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে কমিটির মেয়াদ বাড়িয়ে নেন সিদ্দিকুর রহমান। সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত মার্চ মাসে। সে জন্য গত ডিসেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। কিন্তু জানুয়ারির শেষ দিকে হঠাৎ করেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কমিটির মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর আবেদন করেন বিজিএমইএর সভাপতি। তখন তিনি অজুহাত দেখান—উত্তরায় নতুন ভবন নির্মাণ, নতুন মজুরি বোর্ড গঠন ও জাতীয় সংসদের নির্বাচনের জন্য আগামী এক বছর পোশাক খাতের জন্য কঠিন সময়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সরকারের উচ্চ মহলের নির্দেশে মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়ে দেয়।
ফোরামের নেতা ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘আমরা বিজিএমইএর সাবেক ১১ সভাপতি চাই বিজিএমইএ সুস্থ ও সুন্দরভাবে পরিচালিত হোক। যে কারণেই হোক দুবার মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়টি মেনে নিয়েছি। সভাপতিদের কেউ তৃতীয়বার মেয়াদ বৃদ্ধির পক্ষে না। সবার মতামত নেওয়ার পরই আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি। বাণিজ্যমন্ত্রীকে কমিটির মেয়াদ বৃদ্ধি না করার অনুরোধ জানিয়েছি।’
এদিকে বর্তমান কমিটি নির্বাচনের তফসিল দিলেও সাধারণ সদস্যরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারবেন কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ, সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরামের সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী আগামী মেয়াদে ফোরামের পক্ষ থেকে সভাপতি হওয়ার কথা রয়েছে। শুরুতে ফোরাম সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খানকে সভাপতি পদের জন্য নির্বাচিত করেছিল। তবে তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে গত বছর সবুজ সংকেত মেলেনি। তখন প্রার্থী বদল করা হয়। বর্তমানে মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হককে সভাপতি পদের জন্য নির্বাচিত করেছেন ফোরামের শীর্ষ নেতারা। রুবানা হক ফোরামের প্যানেল লিডার।