তৈরি পোশাক এখনও দেশের প্রধান রফতানি পণ্য। রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে এ খাত থেকে। আর দেশের শিল্প খাতে মূল্য সংযোজনেরও ৪৫ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাকের। সে তুলনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছে চামড়াজাত পণ্য। যদিও সম্ভাবনাময় এ খাতের বিশ্বজুড়ে রয়েছে বড় বাজার। তাই এ খাতের কিছু সংস্কার ও উন্নয়নের সুপারিশ করেছে দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
সংস্থাটি বলছে, একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করা গেলে কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য হতে পারে সম্ভাবনাময় রফতানি পণ্য। আর এর রফতানি ছাড়িয়ে যাবে চারগুণের বেশি। সম্প্রতি এডিবির প্রকাশিত ‘ডেভেলপিং দ্য লেদার ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়েছে।
এডিবির সুপারিশের সঙ্গে একমত বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার আনলে চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে বাংলাদেশ।
এডিবির তথ্যমতে, চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজন ব্যাপক গবেষণা ও অবকাঠামো উন্নয়নের। এছাড়া বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের রফতানি কিছু নির্দিষ্ট বাজারে কেন্দ্রীভূত। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ৪৪ ধরনের চামড়াজাত পণ্য ৮৪টি গন্তব্যস্থলে রফতানি করেছিল। অথচ বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ৫৯ ধরনের পণ্য ১২২টি গন্তব্যে রফতানি করে। এছাড়া বাংলাদেশের নিকটবর্তী দেশ ভারত ৬৩ ধরনের পণ্য ১৯৬টি গন্তব্যে এবং চীন ৬৫ ধরনের পণ্য ২০৯টি গন্তব্যে রফতানি করেছে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য রফতানি আয় ছিল ১২০ কোটি ডলার। তবে এ খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা গেলে বিদ্যমান বাজারেই এ রফতানি ৫০০ কোটি ডলার ছাড়াবে।
সংস্থাটি বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রফতানির তিন দশমিক পাঁচ শতাংশ এসেছে চামড়াজাত পণ্য থেকে। এর পরিমাণ ১২০ কোটি ডলার, যা বিশ্ববাজারের মাত্র দশমিক ছয় শতাংশ। যদিও বাংলাদেশে বিশ্বের মোট গবাদি পশুর (গরু) এক দশমিক আট শতাংশ ও মোট ছাগলের তিন দশমিক সাত শতাংশ মজুদ রয়েছে। এই খাতে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাড়ে আট লাখ মানুষ কাজ করছে, যার ৭০ শতাংশই নারী।
এডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও বিক্রেতা চীন। ২০১৫ সালে দেশটি বিশ্ববাজারের ২৪ দশমিক সাত শতাংশ পণ্য আমদানি করে। আর আমেরিকার মোট আমদানির ৫৩ দশমিক সাত শতাংশ গেছে চীন থেকে। এছাড়া ভিয়েতনাম থেকে ১৫ দশমিক দুই শতাংশ, ভারত থেকে তিন দশমিক চার শতাংশ ও বাংলাদেশ থেকে মাত্র দশমিক আট শতাংশ আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি চামড়াজাতপণ্য রফতানি করেছে জাপানে। ওই বছর বাংলাদেশ জাপানে রফতানি করেছে দেশটির মোট আমদানির সাত দশমিক তিন শতাংশ। তবুও বাংলাদেশ জাপানে চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে ভিয়েতনাম ও চীন থেকে পিছিয়ে ছিল। জাপান ওই সময়ে ১৮ শতাংশ চীন থেকে ও ১৫ দশমিক এক শতাংশ ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করেছে।
এরপরও এই খাতে বাংলাদেশের বড় সম্ভাবনা দেখছে এডিবি। সংস্থাটি বলছে, এ খাতে দ্রুত রফতানির আকার বাড়াতে পারে বাংলাদেশ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ৫০০ কোটি ডলার আয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে। কিন্তু এই অর্জনের জন্য বার্ষিক রফতানি বৃদ্ধির হার বর্তমান ৯ শতাংশ থেকে (২০১৩ থেকে ২০১৭) ১৬ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। চামড়া খাতে বাংলাদেশের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখছে এডিবি। পাশাপাশি এ খাতে ব্যাপক বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। কারণ অত্যন্ত ভালো ও উন্নত মানের চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। সরকারও খাতটিকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে দেখছে। সেই সঙ্গে কম খরচে এ খাতে শ্রমিক পাওয়া যায়।
তবে এসব ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখছে এডিবি। ভালো প্রযুক্তির অপর্যাপ্ত ব্যবহার ও আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির স্বল্পতা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, ব্যয়বহুল আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভরতা, ব্যাংকঋণ পেতে অসুবিধা, প্রচার ও বিপণন কৌশল না থাকা। তবে এ খাতে সুযোগ হিসেবে বলা হচ্ছে রফতানি বাজারের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি, বিদেশে বাংলাদেশের চামড়ার ব্যাপক চাহিদা, অভ্যন্তরীণ বাজারে সম্ভাবনা বৃদ্ধি ইত্যাদি। এছাড়া চামড়া খাতে কিছু হুমকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কঠোর আন্তর্জাতিক মান রক্ষা, এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে শক্ত প্রতিযোগিতা ও ব্যবসা স্থাপনে উচ্চ খরচ।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চামড়াজাত পণ্য রফতানিকারকদের সংগঠন লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সহসভাপতি নাসির খান শেয়ার বিজকে বলেন, এডিবি তাদের প্রতিবেদনে আমাদের নিজেদের কথা বলেছে, এই খাতে সংস্কার ও উন্নয়ন জরুরি।
তিনি বলেন, আমরা অর্থনীতিতে ভ্যালু অ্যাড করলেও সুবিধা পাই না। আমাদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়। তার অভিযোগ, সরকার তৈরি পোশাক মালিকদের একতরফা সুবিধা দিলেও চামড়া পণ্য রফতানিকারকদের সেই সুবিধা দেওয়া হয় না। সরকার মুখে মুখে আন্তরিক হলেও প্রকৃত পক্ষে তা নয়। সব আইনই পোশাক রফতানিকারকদের পক্ষে করা হয়। কিন্তু সেটা করা ঠিক নয়। খাত অনুযায়ী না দেখে সবাইকে রফতানিকারক হিসেবে দেখা দরকার। সবার জন্য সমান সুবিধা থাকা দরকার।
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, সরকারের আন্তরিকতা কম থাকার কারণে আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। তার অভিযোগ, রফতানি করার ক্ষেত্রে তারা পদে পদে হেনস্তার শিকার হন। এগুলো দূর করতে হবে।
এডিবির সুপারিশে বলা হয়, চামড়া খাতে এগিয়ে যেতে বাংলাদেশ ভিয়েতনাম, চীন ও মালয়েশিয়াকে অনুসরণ করতে পারে। এক্ষেত্রে ২০ বছরে ভিয়েতনামের পাদুকা শিল্প তাদের রফতানি আয়ের বড় উৎসে পরিণত হয়েছে। দেশটি বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ পাদুকা রফতানিকারক দেশ, যেখানে দেশটি বিশ্বের ৫০টি দেশ ও অঞ্চলে তাদের উৎপাদিত পাদুকা রফতানি করে থাকে।