Home Bangla Recent নিজেদের উদ্যোগেই বড় হচ্ছে পাদুকাশিল্প

নিজেদের উদ্যোগেই বড় হচ্ছে পাদুকাশিল্প

সবুজ মিয়ার ৫০ হাজার টাকা পুঁজির ব্যবসা এখন ১০ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। এসএসসি পাসের পর ১৯৯৬ সালে পাদুকা ব্যবসায় যুক্ত হন তিনি। নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আরো ১০ জনের আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন তিনি। ছোট পুঁজির ব্যবসাকে তিনি বড় করে তুলেছেন। কিন্তু অর্থের অভাবে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারছেন না।

এমন উদাহরণ দু-একটি নয়, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে গেলেই দেখা মিলবে এমন শত শত ছোট উদ্যোক্তার। যারা স্বল্প পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করলেও, এখন তাদের ব্যবসার চিত্র পাল্টে গেছে। নব্বইয়ের দশকে স্বল্প পুঁজিতে হাতে গোনা কিছু মানুষের উদ্যোগে মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে ভৈরবে গড়ে ওঠে পাদুকা তৈরির কারখানা। চট্টগ্রাম ও ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু ব্যক্তির হাত ধরে এ পাদুকাশিল্পের গোড়াপত্তন। সেই উদ্যোগ এখন অনেক বড় হয়েছে, ভৈরবে স্যান্ডেল ও জুতা তৈরি কারখানার সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০ হাজারের বেশি। ৫০ হাজার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখছে এই শিল্প। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও যথাযথ বাজার ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মার খাচ্ছে দেশীয় এই শিল্প। ভাড়া জায়গায় কারখানা পরিচালিত হওয়ায় ব্যবসা থেকে সরকার পর্যাপ্ত রাজস্ব পাচ্ছে না কিন্তু এই শিল্পের প্রসারে ব্যবসায়ীদের জন্য পাদুকা শিল্পনগরী গড়ে তুললে সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব পাবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যবসায়ীরা জানান, কাঁচামাল ও জনবল সহজলভ্য হওয়ায় ঘরোয়া পরিবেশেও বিকাশ হচ্ছে পাদুকশিল্পের। পরিবারের সদস্যরা মিলেও স্যান্ডেল ও জুতা তৈরি করে সচ্ছলতা নিয়ে এসেছে। কিন্তু তৈরি পণ্য বিক্রিতে রয়েছে বাজারের অভাব। স্বযত্নে গড়া জুতা ও স্যান্ডেল কম মূল্যে স্থানীয় আড়তদার ও বড় ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করছে ছোট ব্যবসায়ীরা। এতে উৎপাদকরা যথাযথ মূল্য থেকে বঞ্চিত হলেও বড় ব্যবসায়ীরা কম মূল্যে কিনে দেশের নানা প্রান্তে সরবরাহের পাশাপাশি দেশের বাইরেও রপ্তানি করছে।

এসএমই ফাউন্ডেশন ২০১৩ সালে ভৈরবের পাদুকাশিল্প নিয়ে ক্ষুদ্র শিল্পটির বিকাশে ‘নিডস অ্যাসেসমেন্ট ফর ক্লাস্টার ডেভেলপমেন্ট’ প্রতিবেদনে চাহিদা নিরূপণ ও সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও বিশেষ অবদান রাখছে। পাইকারি পাদুকা বাজার স্থাপন করা হলে সাধারণ কারখানা মালিকরা উপকৃত হবে। মালিকরা দেশব্যাপী ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার সংগ্রহ করে সরবরাহ করে। কম্পিউটার ব্যবহার করে ই-কমার্স, ই-বিজনেস বিষয়ে সচেতন করার মাধ্যমে ক্লাস্টারে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যেতে পারে।

সরেজমিনে ভৈরব ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষেই পাদুকাশিল্প ক্লাস্টার। উপজেলা পরিষদের আশপাশে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে এই শিল্প। ছোট ঘরের মধ্যে ১০-১২ জনকে নিয়ে একেকটি কারখানা। কোনোটিতে পাঁচ-ছয়জনও রয়েছে। সব মিলিয়ে ৫০ হাজারের বেশি লোকবল কাজ করছে বলে জানায় ব্যবসায়ীরা।

স্থানীয়রা জানায়, বর্তমানে ভৈরব পৌর এলাকা ও উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০টির বেশি গ্রামে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় ১০ হাজারেরও বেশি জুতা তৈরির কারখানা। ভৈরব পৌর এলাকার কমলপুর, জামালপুর, হাজি ফুল মিয়ার পাদুকা মার্কেট, শম্ভুপুরের সালাম মার্কেটসহ মধ্যেরচর, চণ্ডীবেড়, কমলপুর বাসস্ট্যান্ড, সাদুতলাঘাট, শিমুলকান্দিসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব কারখানা গড়ে উঠেছে। ভৈরবে পাদুকাশিল্পের সাফল্য দেখে কুলিয়ারচর, বাজিতপুর ও বেলাব উপজেলাতেও পাদুকাশিল্প গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সরেজমিনে কারখানা ঘুরে দেখা যায়, ফুলমিয়া হাজি মার্কেটে রয়েছে জুতা তৈরির বেশির ভাগ কারখানা। এখানে এক হাজারের বেশি কারখানা রয়েছে বলে জানা যায়। ব্যক্তি জমিতে গড়ে উঠেছে এসব কারখানা। ছোট ছোট ঘরে একেকটি কারখানা, যেখানে ১০-১২ আবার কোথাও পাঁচ-ছয়জন শ্রমিক কাজ করছে।

সজল অ্যান্ড তিশান শুজে ১২ জন কর্মচারী কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠানের হুমায়ুন কবির প্রধান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রমজান শুরুর দুই মাস আগে থেকে জুতা তৈরির মৌসুম শুরু হয়। কোরবানির ঈদ পর্যন্ত শ্রমিকদের দম ফেলার সময় থাকে না। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ চলে।

ভৈরবে পাদুকা শিল্পনগরীতে পরিচিত মুখ মো. হাবিব। তেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও তিনি জুতার দক্ষ কারিগর। জুতা ও স্যান্ডেলের নমুনা তৈরি করেন। গ্রাহক বা ক্রেতার চাহিদামতো মডেল পেলেই তিনি স্বল্প সময়েই তৈরি করে ফেলেন। আবার ইন্টারনেট থেকে জুতার মডেল দেখেও তৈরি করেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাজ দেখে নমুনা তৈরির কাজ শিখেছি। কেবল জুতার মডেল বা নমুনা তৈরিতে ঢাকায় একটা বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছিলাম। পারিশ্রমিক ৪৫ হাজার টাকা, কিন্তু সেটা ছেড়ে দিয়েছি। ভৈরবে পাদুকাশিল্পে সারা দিনে ৮-১০টি মডেল তৈরি করতে পারি। এখান থেকে আয় দিয়েই সচ্ছলভাবে পরিবার চলছে।’

সমস্যা : ১০ হাজারের বেশি কারখানায় সব পণ্যই হাতে তৈরি। আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় হাতেই তৈরি হচ্ছে। দু-একজন বড় ব্যবসায়ী যন্ত্রের মাধ্যমে স্যান্ডেল ও জুতা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। স্যান্ডেল ও জুতা তৈরির বর্জ্য ফেলার জায়গা নেই। নেই কমন ফ্যাসিলিটিজ সেন্টার, যেখানে দক্ষ কারিগর থেকে জুতা ও স্যান্ডেল তৈরির মডেল পাবে। অল্প পুঁজিতে হিমশিম খাচ্ছে, ঋণ পাচ্ছে না ব্যবসায়ীরা। কারখানা মালিকদের নিজস্ব শোরুম বা বিক্রয়কেন্দ্র নেই। আড়তদার বা পাইকারের কাছে পণ্য বিক্রি করে। পুরুষ, মহিলা ও বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের স্যান্ডেল, কেডস ও শু-জুতা তৈরি করে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি নেই। এই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল চামড়া, যা ঢাকা বা আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা হয়।

এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ক্লাস্টারের কলেবর ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ছে। পণ্যের মান উন্নয়নের মাধ্যম রপ্তানি বাজার সৃষ্টির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। জাতীয় পর্যায়েও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ক্লাস্টারের সম্ভাবনা প্রবল বলে উল্লেখ করা হয়।

ভৈরব পাদুকা কারখানা মালিক সমিতির সভাপতি আল আমিন মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বস্ত্র খাতের পর পাদুকাশিল্পেই সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক কাজ করছে। ঘরোয়া পরিবেশে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করে বেকারত্ব দূর করছে এই শিল্প। বড় ও নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলো এখান থেকে জুতা-স্যান্ডেল নিয়ে নিজেদের নামে বিক্রি করছে।’

তিনি বলেন, প্রতিবছরই জুতা তৈরির কারখানা বাড়ছে। কিন্তু তা বিক্রির যথাযথ বাজার নেই। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব বলে মনে করছেন তিনি। এ জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও ব্যবসা সম্প্রসারণে ঋণ প্রয়োজন। আমদানি বন্ধ হলেও দেশে তৈরি জুতাতে চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে দাবি করেন তিনি।

ব্যবসায়ী সবুজ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, শ্রমিকের সহজলভ্যতায় এই শিল্পের সম্ভাবনা অনেক। প্রতিবছরই এক হাজার নতুন কারখানা গড়ে উঠছে। আকার ছোট হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা মিলে ব্যবসা শুরু করছে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও অবসর সময়ে এসে কাজ করছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here