পোশাক শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি
শ্রমঘন পোশাক খাতের মজুরি বোর্ড গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি। বোর্ডের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯ মার্চ। ওই সভায় মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষকে দ্বিতীয় সভার আগেই নতুন মজুরি কাঠামোর প্রস্তাবনা জমা দিতে বলা হয়। প্রথম সভার সাড়ে তিন মাস পর ৮ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সভা। ওই সভায় উভয় পক্ষ নতুন কাঠামো নিয়ে প্রস্তাবনা জমা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। এ অবস্থায় ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে প্রস্তাবনা জমা দেয়ার নতুন সময়সীমা নির্ধারণ করে মজুরি বোর্ড।
১৬ জুলাই বোর্ডের তৃতীয় সভায় পোশাক শ্রমিকদের জন্য ৬ হাজার ৩৬০ টাকা নিম্নতম মূল মজুরি নির্ধারণের প্রস্তাব করে মালিকপক্ষ। শ্রমিকপক্ষের দাবি ছিল ১২ হাজার ২০ টাকা। দুই পক্ষের প্রস্তাবনার এ ফারাক কমিয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর ৮ হাজার টাকা নিম্নতম মজুরির নতুন কাঠামোর ঘোষণা দেয়া হয়। ১২ অক্টোবর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৪ হাজার ১০০ টাকা মূল মজুরি ধরে মোট ৮ হাজার টাকা নিম্নতম মজুরির খসড়া কাঠামো সুপারিশ প্রকাশ করে নিম্নতম মজুরি বোর্ড। পরবর্তীতে এ কাঠামো চূড়ান্ত করে ২৫ নভেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
নতুন এ মজুরি কাঠামো শ্রমিকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। একসময় শ্রমিক অসন্তোষ রূপ নেয় বিক্ষোভে। ৯ ডিসেম্বর আশুলিয়ার বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রেখে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে কয়েকটি কারখানা ভাংচুরও করেন তারা। পরবর্তীতে গাজীপুরের কিছু পোশাক কারখানার শ্রমিকরাও বিক্ষোভে যোগ দেন।
শ্রমিক নেতাদের মতে, নতুন মজুরি কাঠামো পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে প্রহসনের নামান্তর। শ্রমিক সংগঠনগুলো অভিযোগ তুলেছে, মালিকপক্ষের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে সরকার শ্রমিকদের সঙ্গে বঞ্চনামূলক এ মজুরি কাঠামো ঘোষণা করেছে।
অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের যাওয়া না-যাওয়া
দেশের পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ ও শ্রমনিরাপত্তা নিয়ে জাতীয় পরিদর্শন ব্যবস্থার চরম দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রেতা ও আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একাধিক জোট। এর একটি হলো ইউরোপভিত্তিক অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ (অ্যাকর্ড)। অন্যটি হলো অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি (অ্যালায়েন্স)।
অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স উভয়ই তাদের সদস্য ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে, বাংলাদেশে এমন পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ, শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ, অগ্নিনিরাপত্তা, ভবনের নিরাপত্তা ইত্যাদি তদারকি করে।
বাংলাদেশে জোট দুটোর কার্যক্রমের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছরের। চলতি বছরের ৩১ মে অ্যাকর্ডের ও ৩০ জুন অ্যালায়েন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে পরবর্তীতে আরো ছয় মাসের সময় দেয়া হয়। সে অনুযায়ী, আজকের মধ্যেই কার্যক্রম গুটিয়ে চলে যাওয়ার কথা অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের।
বছরজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল জোট দুটির যাওয়া না-যাওয়া। এ বিষয়ে অ্যালায়েন্সের অবস্থান নমনীয় থাকলেও মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কার্যক্রম চালিয়ে নিতে চেয়েছিল অ্যাকর্ড। কিন্তু সরকার তাদের মেয়াদ বাড়াতে রাজি নয়। ৩১ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানান, ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যক্রম চালাতে পারবে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স। এরপর আর তাদের মেয়াদ বাড়ানো হবে না। ১২ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে তিনি একই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। সাফ জানিয়ে দেন, বর্ধিত সময়ের পর অ্যাকর্ডের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না।
এদিকে মেয়াদ শেষের পর ‘ট্রানজিশনাল অ্যাকর্ড’ নামে জোটটির কার্যক্রম আরো ছয় মাস চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, ৩১ নভেম্বরের পর বাংলাদেশে আর কার্যক্রম চালাতে পারবে না এ জোট। এ অবস্থায় অ্যাকর্ডের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশকে চাপ দেয়ার জন্য ১৬ অক্টোবর ইউরোপীয় ট্রেড কমিশনারকে চিঠি দেন অর্ধ শতাধিক ডাচ এমপি।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নিজেদের কার্যক্রম গোটানোর পরিকল্পনা সরকারের কাছে হস্তান্তরের কথা জানায় অ্যাকর্ড। ছয় ধাপের এ পরিকল্পনায় সরকার গঠিত রিমেডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেলের (আরসিসি) সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার সুযোগ চায় অ্যাকর্ড। পরবর্তীতে ১৫ অক্টোবর থেকে সরকারের কাছে কারখানা তদারকির দায়িত্ব হস্তান্তর শুরুর ঘোষণা দেয় ইউরোপভিত্তিক জোটটি। ২৪ অক্টোবর তারা প্রাথমিক পরিদর্শন সম্পন্ন করা ২০টি কারখানা তদারকির দায়িত্ব আরসিসির কাছে হস্তান্তর করে।
এদিকে চলতি মাসের মাঝামাঝিতে অ্যালায়েন্স জানায়, বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার পর স্থানীয় সংস্থার মাধ্যমে আওতাভুক্ত কারখানাগুলোয় নিরাপত্তা মানদণ্ড পর্যবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ প্রদান ও হেল্পলাইন উন্নয়নের কাজ অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তারা। নিজেদের পঞ্চম বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশকালে জোটটি এ কথা জানায়। ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, অ্যালায়েন্সের পর্যবেক্ষণের আওতাধীন কারখানাগুলোর ৯৩ শতাংশ সংস্কারকাজ সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে জীবনের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। অ্যালায়েন্স অধিভুক্ত ৪২৮টি কারখানা তাদের সংশোধনী কর্মপরিকল্পনায় উল্লিখিত সব সংস্কার সম্পন্ন করেছে। প্রায় ১৬ লাখ শ্রমিক অগ্নিকাণ্ডের জরুরি মুহূর্তে নিজেদের রক্ষার কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরে সবচেয়ে কম অপেক্ষমাণ জাহাজের রেকর্ড
দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর। বড় বড় চালানের বেশির ভাগই এ বন্দর দিয়ে আনা-নেয়া করা হয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখা এবং রফতানি পণ্য বিদেশী ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটি মূল ভূমিকা পালন করে। দেশের সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটাই চট্টগ্রাম বন্দরনির্ভর। এ কারণে বন্দরের ওপর চাপও থাকে অনেক বেশি। ফলে সময়মতো জাহাজ থেকে পণ্য খালাস অথবা রফতানি পণ্যের জাহাজীকরণ অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না।
আগে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভিড়তে জাহাজগুলোকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো। কিছুদিন আগেও প্রতিদিন গড়ে ১৬টি জাহাজকে অপেক্ষমাণ থাকতে হয়েছে। এর কারণ ছিল বন্দরের জেটিতে পণ্য খালাসের কাজে জাহাজের গড় অবস্থানকাল বেশি থাকা। এক বছর আগেও যখন বন্দরে জাহাজের গড় অবস্থানকাল ছিল সাত থেকে আটদিন, সেখানে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে তা দুদিনের কমে নেমে আসে। ফলে কমে যায় জাহাজের গড় অবস্থানের সময়ও। ২৮ নভেম্বর মাত্র একটি কনটেইনারবাহী জাহাজকে অপেক্ষমাণ থাকতে হয়, যা বন্দরের ইতিহাসে রেকর্ড।
জাহাজের অবস্থানকাল ও অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন। নভেম্বরেই বন্দরে যুক্ত হয় নতুন ছয়টি কি-গ্যান্ট্রি ক্রেন।
স্থলবন্দরে অটোমেশন: বেনাপোল-ভোমরায় ভিন্ন চিত্র
দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর যশোরের বেনাপোল। স্থলপথে আমদানি-রফতানির প্রধান ট্রানজিট এটি। সরকার প্রতি বছর বন্দর থেকে গড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করলেও এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন বরাবরই উপেক্ষিত ছিল। আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও বন্দরের কার্যক্রমে ম্যানুয়াল পদ্ধতির ব্যবহার ছিল বেশি। দীর্ঘদিন ধরেই বন্দরে অটোমেশন চালুর দাবি থাকলেও তা পূরণ হচ্ছিল না। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নভেম্বরে অটোমেশনের আওতায় আসে বেনাপোল স্থলবন্দর। কয়েকটি দপ্তরে এ প্রক্রিয়ায় কাজ শুরু হয়েছে।
এদিকে বন্দরে পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগও অনেক দিনের। শেডে সংকুলান না হওয়ায় অনেক পণ্যই বন্দরের ইয়ার্ডে খোলা ফেলে রাখতে হয়। মাঝে মধ্যেই অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকা পণ্য চুরি হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ফলে বন্দরকে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছিল। ১৯ নভেম্বর বন্দরের বিভিন্ন পণ্যাগারে সিসি ক্যামেরা লাগানোর কাজ শুরু হয়।
বেনাপোল স্থলবন্দরে অটোমেশন চালুর বিষয়টিকে সেখানকার ব্যবসায়ীরা স্বাগত জানালেও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ১৪ নভেম্বর বন্দরের ওয়্যারহাউজে পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশের ক্ষেত্রে অটোমেশন চালুর মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের আপত্তির মুখে এ ডিজিটাল সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অটোমেশন চালুর পর ব্যবসায়ীদের অনেক বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হচ্ছিল। নতুন চালু হওয়ায় এ প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণ হচ্ছিল বেশি। পণ্য নামিয়ে খালি ট্রাক ওজন করা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। পরে বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত অটোমেশন পদ্ধতির ব্যবহার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।