গত দুই বছরে প্রায় এক ডজন শিল্প খাতের নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গঠিত মজুরি বোর্ড। এর মধ্যে বড় শিল্প খাত হিসেবে আছে তৈরি পোশাক, বস্ত্র, ট্যানারি ও ফার্মাসিউটিক্যাল। এসব শিল্প খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ন্যূনতম মাসিক মোট মজুরি ট্যানারি শ্রমিকদের, ১২ হাজার ৮০০ টাকা। ফার্মাসিউটিক্যাল ও পোশাক শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন মাসিক মোট মজুরি ঘোষিত হয়েছে যথাক্রমে ৮ হাজার ৫০ ও ৮ হাজার টাকা। ঢাকায় কার্যক্রম আছে, এমন বাকি অন্য সব শিল্পের সর্বনিম্ন মাসিক মোট মজুরিই ৬ হাজার টাকার নিচে।
সর্বনিম্ন মাসিক এ মজুরি রাজধানী ও আশপাশের জীবনযাত্রার ব্যয়ের বেশ নিচে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সর্বশেষ ২০১৬ সালে আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ঢাকা ও এর উপকণ্ঠে জীবন নির্বাহ মজুরি (লিভিং ওয়েজ) হিসাব করে। আইএলও স্বীকৃত অ্যাঙ্কার মেথডোলজির ভিত্তিতে লিভিং ওয়েজ হিসাব করতে বিবেচনায় নেয়া হয় মানসম্পন্ন জীবনযাপনের জন্য খাদ্য, পানি, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন, পোশাক, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মোকাবেলা ও অন্যান্য অপরিহার্য প্রয়োজনকে। ঢাকার মিরপুর ও পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, আশুলিয়ার শ্রমিকদের দৈনন্দিন খরচের মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি দেখায়, ঢাকার উপকণ্ঠের শহরগুলোয় শ্রমিকের লিভিং ওয়েজ ১৩ হাজার ৬৩০ ও ঢাকা শহরে ১৬ হাজার ৪৬০ টাকা।
শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি ও জীবন নির্বাহ মজুরির মধ্যকার এ ব্যবধান দূর করতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানান শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশের শিল্প-কারখানাগুলোর বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন। শ্রমিকরা শিল্প শুরুর গোড়াতেই বঞ্চিত হয়েছেন। শুধু পোশাক শিল্পের কথাই যদি ধরি, তাহলে এ খাতে শ্রমিকের মজুরি ছিল ১ হাজার ৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা। বর্তমান সরকার আসার পর ২০১০ সালে ৩ হাজার টাকা করা হলো। ২০১৩ সালে করা হলো ৫ হাজার ৩০০ আর এখন ৮ হাজার টাকা। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগেই এ হারে মজুরি বেড়েছে। যেহেতু গোড়াতেই বঞ্চনার শুরু, তাই এখন প্রয়োজনের সঙ্গে পার্থক্য কমাতে সময় লাগছে। এ বাস্তবতা মাথায় রেখেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
দেশের শিল্প খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক। বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশের বেশি আয় করা খাতটিতে কর্মরত আছেন ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক। তাদের বড় অংশের বাস ঢাকার উপকণ্ঠ সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে। ঢাকার অভ্যন্তরের পোশাক শ্রমিকরা বাস করেন মূলত মিরপুর, রামপুরা, বাড্ডা ও উত্তরার মতো এলাকায়। কারখানা থেকে স্বল্প দূরত্বে ঘর ভাড়া করে একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকেন অনেকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অস্বাস্থ্যকর ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকতে হয় তাদের। মজুরি বোর্ডের সর্বশেষ মজুরি কাঠামো অনুযায়ী, এ শিল্পের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মাসিক মোট মজুরি ঘোষিত হয় ৮ হাজার টাকা। এ মজুরি ঢাকার জীবন নির্বাহ মজুরির অর্ধেকেরও কম।
বার্ষিক মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি বছরই শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয় বলে জানান তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ২০১৩ সালের মজুরি কাঠামো অনুযায়ী এটা করা হচ্ছে। শ্রমিকের মজুরি জীবন নির্বাহ মজুরির নিচে, এমন তথ্য আমার কাছে যথার্থ মনে হচ্ছে না। কারণ আমরা জরিপ করে দেখেছি, বর্তমান মজুরি হারে একজন শ্রমিক মাস শেষে স্বল্প হলেও সঞ্চয় করতে পারেন।
যদিও ঢাকার পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মাসিক মোট মজুরিতে জীবন নির্বাহের ন্যূনতম চাহিদাও মেটে না বলে দাবি শ্রমিক প্রতিনিধিদের। সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে মানসম্পন্ন আবাসন, পুষ্টি ও আনুষঙ্গিক খরচ বিবেচনায় নেয়া হয় না। সেজন্যই পোশাক শ্রমিকের মজুরির হার লিভিং ওয়েজের চেয়ে অনেক নিচে। একটি পোশাক উৎপাদন থেকে আয়ের অধিকাংশই পান ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কারখানা পর্যন্ত মধ্যস্বত্বভোগীরা। সেখানে শ্রমিকরা পান খুব সামান্যই।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত ট্যানারি। ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, এ শিল্পে কর্মরত আছেন ২৫-৩০ হাজার শ্রমিক। শিল্পটি সাভারে স্থানান্তর হলেও শ্রমিকদের একটি অংশ এখনো থাকেন হাজারীবাগে। বাকিরা সাভারে ট্যানারি শিল্পসংলগ্ন আবাসন ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোয় বসবাস করেন। হাজারীবাগে ছোট ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে হয় শ্রমিক পরিবারগুলোকে। সাভারেও ট্যানারি শিল্পের শ্রমিকদের বড় অংশের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন, হাসপাতাল, স্কুল সুবিধা নেই। ২০১৮ সালে এ শিল্পের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মাসিক মোট মজুরি ঘোষণা করা হয় ১২ হাজার ৮০০ টাকা। এ মজুরি অন্যান্য শিল্প খাতের তুলনায় বেশি হলেও জীবন নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরির চেয়ে কম।
দেশের আরেক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ফার্মাসিউটিক্যাল। এ শিল্পে প্রতিষ্ঠান রয়েছে আড়াইশর বেশি। ২০১৭ সালে সর্বশেষ নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করে নিম্নতম মজুরি বোর্ড। ঘোষিত কাঠামো অনুযায়ী, এ শিল্পের শ্রমিকরা সর্বনিম্ন মাসিক মজুরি পাচ্ছেন ৮ হাজার ৫০ টাকা। এ মজুরিও ঢাকা ও আশপাশের জীবন নির্বাহ মজুরির চেয়ে অনেক কম।
ওষুধ শিল্পের কারখানাগুলোয় মজুরিসংক্রান্ত কোনো সমস্যা নেই বলে দাবি করেন ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মজুরি বোর্ডের নিম্নতম হারের চেয়ে অনেক বেশি পান ওষুধ শিল্পের বিভিন্ন কোম্পানির শ্রমিকরা। দৃশ্যমান কোনো অস্থিরতা না থাকায় এটা জোর দিয়েই বলা যায়, লো-ওয়েজ সংক্রান্ত যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা এ খাতের জন্য প্রযোজ্য নয়।
রফতানিমুখী বস্ত্র খাতে কর্মরত আছেন প্রায় ৬ লাখ শ্রমিক। এছাড়াও জামদানি, তাঁত, স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিল, টেরিটাওয়েল, হোম-টেক্সটাইল মিলগুলোও এ খাতের মধ্যে পড়ে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় এ ধরনের সব প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে এ খাতে কর্মরতদের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। কটন টেক্সটাইল শিল্পের আওতায় রয়েছে বিটিএমএর সদস্য স্পিনিং, উইভিং ও ডায়িং মিলগুলো। সারা দেশে নিয়োজিত ছোট ও বড় বস্ত্র মিলের শ্রমিকরাও রয়েছেন এর আওতায়। এ খাতের শ্রমিকদের জন্য সর্বশেষ মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয় গত বছর। ঘোষিত কাঠামো অনুযায়ী, খাতটির শ্রমিকরা সর্বনিম্ন মাসিক মজুরি পাচ্ছেন ৫ হাজার ৭১০ টাকা।
সর্বশেষ ঘোষিত মজুরি কাঠামো অনুযায়ী, ঢাকার অন্যান্য শিল্প খাতের মধ্যে অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল শিল্পের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মাসিক মোট মজুরি ৮ হাজার ৭০০ টাকা। অ্যালুমিনিয়াম ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল শিল্পের মোট কারখানার সংখ্যা ছোট-বড় মিলিয়ে দুই শতাধিক। খাতটিতে কর্মরত আছেন প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক।
বাংলাদেশ ড্রেস মেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, সারা দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৪ হাজার দর্জি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করেন ১০ লাখের বেশি মানুষ। ২০১৮ সালে ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামো অনুযায়ী, বিভাগীয় শহরগুলোয় এ খাতের শ্রমিকরা সর্বনিম্ন মাসিক মোট মজুরি পাচ্ছেন ৫ হাজার টাকা।
এছাড়া সোপ/কসমেটিকস শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মাসিক মোট মজুরি ৫ হাজার ৬৪০, হোসিয়ারি শিল্পে ৪ হাজার ৬৫০ ও হোটেল/রেস্টুরেন্ট শিল্পে ৩ হাজার ৭১০ টাকা।
শ্রমিকদের নিম্ন মজুরির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে বলে জানান বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, শ্রমিকরা তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে সংগঠিত হতে পারছেন না। এমপ্লয়ারদেরও বৈশ্বিক বাজারে মূল্য নিয়ে দরকষাকষি করতে হয়। মালিকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতাও আছে। এ সমস্যার সমাধান না হলে জীবনযাত্রার চাহিদার চেয়ে কম মজুরির সমস্যা থেকেই যাবে।