নারী শ্রমিকদের ‘বঞ্চনাকারী’ পোশাক কারখানায়ই তৈরি হয়েছে লৈঙ্গিক সম-অধিকারের প্রচারণায় ব্যবহৃত টি-শার্ট। পরিহাসের এ চিত্র উঠে এসেছে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান-এর অনুসন্ধানে। পত্রিকাটি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ব্রিটেনের দাতব্য প্রতিষ্ঠান কমিক রিলিফ বাংলাদেশের একটি পোশাক কারখানা থেকে টি-শার্ট তৈরি করিয়েছে, যেখানে শ্রমিককে ঘণ্টায় মাত্র ৩৫ পেনি বা ৩৮ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, এই শ্রমিকদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়, হেনস্তা করা হয়। তাঁদের দিনে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
গার্ডিয়ান গত রোববার ‘স্পাইস গার্লস টি-শার্ট মেড ইন ফ্যাক্টরি পেয়িং স্টাফ ৩৫ পেনি অ্যান আওয়ার’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদক সাইমন মারফি বাংলাদেশের গাজীপুর থেকে এই প্রতিবেদন লিখেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিক রিলিফ ‘লৈঙ্গিক সমতা’ শীর্ষক প্রচারণার জন্য #আইওয়ানাবিআস্পাইসগার্ল লেখাসংবলিত টি-শার্টগুলো তৈরি করিয়েছে। ১৯ পাউন্ড ৪০ পেনিতে (২,১০০ টাকা) এই টি-শার্ট বিক্রি হবে, যার মধ্যে ১১ পাউন্ড ৬০ পেনি (১,২৫০ টাকা) যাবে দাতব্য প্রতিষ্ঠানটির তহবিলে।
এই টি-শার্ট বিক্রির যে অংশ কমিক রিলিফ পাবে, তা ব্যয় হবে নারীর সমতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সুপরিচিত ব্রিটিশ ব্যান্ড দল স্পাইস গার্লস এই লক্ষ্যের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে বলেছে, তাদের ব্যান্ডের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমতা ও জনগণের ক্ষমতায়ন। কিন্তু পরিহাসের ব্যাপার হলো, যে নারী শ্রমিকেরা এই টি-শার্ট বানাচ্ছেন, তাঁরাই বঞ্চনার শিকার। তাঁদের একজনকে ব্রিটিশ টিভি উপস্থাপক হলি উইলোঘবি সামাজিক মাধ্যমে হাজির করেছেন, যিনি সেখানে বলেছেন, ‘আমাদের মজুরি যথেষ্ট নয় এবং কর্মপরিবেশ অমানবিক।’
স্পাইস গার্লসের মুখপাত্র এই কথা শুনে মন্তব্য করেন, নারী শ্রমিকদের এই অবস্থার কথা শুনে তাঁরা অত্যন্ত সংক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। তিনি ব্যক্তিগত অর্থায়নে কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে তদন্ত করবেন বলে জানিয়েছেন। কমিক রিলিফও বলেছে, তারা ‘সংক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন’।
কমিক রিলিফ ও স্পাইস গার্লস উভয়েই বলেছে, রিপ্রেজেন্ট নামের যে অনলাইন সরবরাহকারীকে স্পাইস গার্লস এই টি-শার্ট তৈরির কাজ দিয়েছিল, তাদের কাছে বিষয়টি জানতে চেয়েছে তারা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রিপ্রেজেন্ট তাদের না জানিয়েই অন্য কারখানাকে কাজ দিয়েছে। রিপ্রেজেন্ট বলেছে, তারা এর পূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছে এবং ক্রেতারা চাইলে টাকা ফিরিয়ে দেবে। স্পাইস গার্লস বলেছে, রিপ্রেজেন্টের উচিত, এ রকম অন্যায় রোধের প্রচারণায় অনুদান দেওয়া।
বাংলাদেশের যে কারখানায় টি-শার্টগুলো তৈরি হয়েছে, সেই কারখানার মূল প্রতিষ্ঠান ইন্টারস্টফ অ্যাপারেলস এ বিষয়ে গার্ডিয়ানকে বলেছে, তারা এ বিষয়ে তদন্ত করবে। তবে তারা এ-ও বলেছে, এসব মোটেও সত্য নয়।
দ্য গার্ডিয়ান-এর অনুসন্ধানে উঠে আসে, এসব শ্রমিকের অনেকের মজুরি ৮ হাজার ৮০০ টাকা (৮২ পাউন্ড)। শ্রমিকেরা দীর্ঘদিন ১৬ হাজার টাকা মজুরির দাবি করে এলেও তা মানা হয়নি। শ্রমিকদের প্রায়ই ‘অসম্ভব’ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অতিরিক্ত সময় কাজ বা ওভারটাইম করতে বাধ্য করা হয়। এমনকি দিনে ১৬ ঘণ্টাও কাজ করেন তাঁরা। মধ্যরাত পর্যন্তও কাজ করতে হয় কখনো। শ্রমিকেরা লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে তাঁদের গালাগালি করা হয়। অনেকে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হন।
ব্রিটেনের প্রচারণা গোষ্ঠী লেবার বিহাইন্ড দ্য লেবেলের পরিচালক ডমিনিক মুলার বলেন, বাংলাদেশের কারখানায় যা হচ্ছে তা ‘বেআইনি কার্যকলাপের সাধারণ সীমা ছাড়িয়ে গেছে’। তিনি আরও বলেন, ‘সেলিব্রিটি, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলোর নিশ্চিত করতে হবে, যেসব কারখানায় এসব পোশাক তৈরি হয়, সেখানে যেন শ্রমিকদের শোভন মজুরি ও কর্মপরিবেশ দেওয়া হয়।’
বেলজিয়ান ব্র্যান্ড স্ট্যানলি/স্টেলার এই টি-শার্ট তৈরির প্রক্রিয়া নজরদারি করার কথা। প্রতিষ্ঠানটির সাসটেইনেবিলিটি ম্যানেজার ব্রুনো ভ্যান সিয়েলেম বলেন, গার্ডিয়ান-এর অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তারা আরও তদন্ত করছে।