একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে টানা দুই বছর রফতানি কমে গিয়েছিল আশঙ্কাজনক হারে। তবে সেই ধারা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই শতাংশের কিছু বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, সেখানে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশেরও বেশি। তবে পঞ্জিকা বর্ষ অনুযায়ী ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ছয় শতাংশ। যদিও বাংলাদেশের তুলনায় প্রতিযোগী দেশগুলোর অবস্থান আরো বেশি উজ্জ্বল।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের (ইউএসআইটিসি) তথ্য পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
মূলত যুক্তরাষ্ট্রের মন্দা কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি বাংলাদেশের পোশাক খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। একটা প্রচ্ছন্ন মন্দার কবলে পড়ে ২০১৫-১৬ সালে সারাবিশ্ব থেকে পণ্য আমদানি কমে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের। ২০১৬ সালে তাদের মোট আমদানি ছিল আগের বছরের তুলনায় কম। এটি কাটিয়ে উঠে ২০১৭ সালে তাদের আমদানি বেড়েছে সাত শতাংশ। আর ২০১৮ সালে তা আরো বেড়ে হয়েছে ৯ শতাংশ। এই হিসেবে বাংলাদেশ থেকে তাদের আমদানির প্রবৃদ্ধি অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। কারণ তাদের মোট আমদানির প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশ হলেও বাংলাদেশ থেকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। সেই তুলনায় এবার আমাদের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তার মানে এই নয় যে, আমরা অনেক এগিয়ে গিয়েছি। কারণ আমাদের প্রতিযোগীরা আরো বেশি জোরে এগিয়ে যাচ্ছে। কম্বোডিয়া আমাদের বাজারে ভাগ বসাতে এগিয়ে আসছে। কারণ, তাদের প্রবৃদ্ধি ২৫ শতাংশের ওপরে।
তবে রফতানিকারকরা বলছেন, পোশাক খাতে বিভিন্ন সংস্কারের কারণে ক্রেতাদের আস্থা বেড়েছে। এ জন্যই আমাদের রফতানি বাড়ছে। যদিও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের প্রতিযোগী সক্ষমতা এখনো কম।
একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বাংলাদেশের মোট রফতানি আয় ২৪১৭ কোটি ৯৫ লাখ মার্কিন ডলার। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকেই এসেছে ৪০৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার। যা মোট রফতানির ৬ শতাংশ। এ বাজারে বাংলাদেশের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক।
ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানি হয়েছিল ৫৮৪ কোটি ৬৬ লাখ মার্কিন ডলারের। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে দুই শতাংশ বেড়ে রফতানি হয় ৫৯৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। এরপর চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাস তথা জানুয়ারি পর্যন্ত রফতানি হয়েছে ৪০৪ কোটি ৪২ লাখ ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি আয় হয়েছিল ৩৪৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসআইটিসির তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে তারা বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৫৬৬ কোটি ৮ লাখ ডলারের পণ্য। আগের বছর একই সময়ে এটি ছিল ৫৩০ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও প্রতিযোগী দেশগুলোর অবস্থান আরো ঈর্ষণীয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিতে কম্বোডিয়ার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৫ শতাংশ। ভারতের প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ১১ শতাংশ। আবার চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধ চলমান থাকলেও চীনের পণ্য রফতানি বেড়েছে সাত শতাংশ। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির সময়েও এই ভিয়েতনামের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশ থেকে তাদের রফতানির পরিমাণও প্রায় ১০ গুণ বেশি। তবুও প্রবৃদ্ধির ধারায় বাংলাদেশে এগিয়ে গেছে। আলোচিত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের আমাদের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২২ শতাংশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে তা ‘লো বেজ’ থেকে হয়েছে। বাস্তবে দুই বছর আগের তুলনায় খুব বেশি যে বেড়েছে তা কিন্তু নয়। তবে নেতিবাচক অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসেছে এটাই ইতিবাচক দিক। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে প্রতিযোগী দেশগুলো কত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কম্বোডিয়া যদি ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে এগিয়ে যায়, তাহলে দুই তিন বছরের মধ্যে তারা আমাদের বাজার ধরে ফেলবে। এটা অবশ্যই এ্যালার্মিং। এক্ষেত্রে আমাদের প্রতিযোগী সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। পোশাক পণ্য সেখানে যাচ্ছে উচ্চ শুল্ক দিয়ে, কিন্তু এমন অনেক পণ্য আছে যেগুলো কম শুল্কে সেখানে ঢুকতে পারে। সেদিকে নজর দিতে হবে আমাদের।’
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি ফারুক হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ক্রেতা দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী আমরা কারখানাগুলোর সংস্কার করেছি। এর ফলে বায়ারদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি আমরা। এ ছাড়া প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে এখানে। যার ফলে উচ্চমূল্যে পণ্য আমরা এখন তৈরি করতে পারছি। আগে আমরা শুধু বেসিক পোশাক তৈরি করতাম। এখন স্যুট, ক্রীড়া পোশাক, নানা ধরনের ডেনিমসহ উচ্চমূল্যে পোশাক তৈরি শুরু হয়েছে বাংলাদেশে।
এর ফল আমরা পেতে শুরু করেছি।’ প্রতিযোগী দেশগুলোর এগিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতিযোগী সক্ষমতায় তারা এগিয়ে আছে। নিজেদের মুুদ্রার অবমূল্যয়ান হওয়ায় এবং ব্যাংক ঋণে সুদ কম হওয়ায় তারা সুবিধা পাচ্ছে। এ ছাড়া অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে আমাদের ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ ওদের তুলনায় অনেক বেশি। এ দিকটাতে নজর দিলেই আমরা যে কেন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যেতে সক্ষম হব।’