সাম্প্রতিক সময়ে বেতন বাড়ানোর দাবিতে টানা আন্দোলনে অস্থিতিশীল হয়ে উঠে দেশের পোশাক খাত। অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে ছয়টি গ্রেডে বেতন বাড়ানোর পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও শ্রমিক ছাঁটাই ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে চলে গেছেন মালিক-শ্রমিকরা। মালিকরা বলছেন, কাউকে অন্যায়ভাবে ছাঁটাই করা হচ্ছে না। আন্দোলনের কারণে ছাঁটাই-এরকম অভিযোগও ভিত্তিহীন। অন্যদিকে শ্রমিক নেতারা বলছেন, শ্রমিকরা মালিকের কাছে জিম্মি। এখন পর্যন্ত পরিবেশ শান্ত। আগামীতে কী হবে তা বলা যাচ্ছে না বলে জানান তারা।
এসব ইস্যু নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। গণহারে ছাঁটাই প্রক্রিয়ায় শ্রমিকরা আবারো মাঠে নামতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেতন বাড়ানোর দাবিতে বাংলাদেশে সামপ্রতিক শ্রমিক আন্দোলন শেষ হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২৭ কারখানা থেকে সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণেই এ রকম ছাঁটাই হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পোশাক শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা। অন্যদিকে ছাঁটাইয়ের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক রিটেইল চেইন ‘এইচ অ্যান্ড এম’।
প্রসঙ্গত, গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে রাজধানী ও এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে আন্দোলনে নামে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা। সরজমিন আশুলিয়ার বেশ কয়েকটি কারখানায় চাকরিচ্যুত করার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এসব কারখানায় চাকরিচ্যুতদের ছবিসহ তালিকা গেট ও আশেপাশের দেয়ালে সেঁটে দেয়া হয়।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, অন্যায়ভাবে কাউকে ছাঁটাই করা হচ্ছে না। আন্দোলনের পরে গণহারে ছাঁটাই করা হচ্ছে-এরকম অভিযোগ ভিত্তিহীন। তবে শ্রম আইন মোতাবেক, কেউ যদি শ্রমিককে প্রাপ্য বেতন বুঝিয়ে দিয়ে বাদ দেয় তাহলে কিছু করার নেই। তিনি বলেন, বেতন বৃদ্ধির কারণে একটি ফ্যাক্টরি বেতন দিতে পারছে না। শ্রম আইন অনুযায়ী, ওই কারখানা শ্রমিকদের সব পাওনা পরিশোধ করে বাদ দিলে বিজিএমইএ কোনো কিছু করতে পারবে না। তবে কোনো কারখানা আইন লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে বিজিএমইএ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে বলে জানান তিনি।
বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানান, তারা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করেছেন। এক নারী শ্রমিক বলেন, ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের তালিকায় আমার নাম শীর্ষে দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। তিনি বলেন, বিক্ষোভের সময় আমি প্রতিদিন কাজে গেছি। আমি কখনোই কোনো ভাঙচুর বা অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমার ও আমার সহকর্মীদের নাম তালিকায় আসার পেছনে কারণ ছিল, আমরা একটি জোট গঠনের চেষ্টা করছিলাম।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, এই মুহূর্তে ইন্ডাস্ট্রি ঠাণ্ডা আছে। শ্রমিকরা কোনো কিছু করছে না। কিন্তু মালিকরা প্রচণ্ড ঝামেলা করছে। তারা শ্রমিকদের ধরপাকড়ে সহায়তা করছে। তিনি বলেন, কারখানা মালিকরা যদি এরকম করে আমাদের কি করার আছে, আমরা তো মালিকদের কাছে জিম্মি।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি তৌহিদুর রহমান বলেন, ছাঁটাইয়ের বিষয়ে মালিকরা হুঁশিয়ারি দিয়েই চলেছেন। বেশকিছু শ্রমিক আমাদের জানিয়েছেন যে, কারখানায় লিস্ট তৈরি হচ্ছে।
এইচ অ্যান্ড এম এক বিবৃতিতে বলেছে, সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং এইচ অ্যান্ড এমের পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের কল্যাণে তারা সব পক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এইচ অ্যান্ড এম বলছে, কারখানা থেকে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিষয়ে তারা অবগত এবং সব পক্ষের সঙ্গে তারা নিবিড়ভাবে কাজ করছে, যাতে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ও সঠিক কারণ নিশ্চিত করার বিষয়ে ওই চুক্তিতে সব পক্ষ সম্মত হয়।
একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেন, ভাঙচুর ও কারখানার ক্ষয়ক্ষতির ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে সাসপেনশন দেয়া হয়েছে। এটি ছাঁটাই কিংবা টার্মিনেশন নয়। শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা অনুযায়ী কারখানা বন্ধ করে সাসপেনশন দেয়া হয়েছে। শ্রমিকদের সব ধরনের আইনি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। যতদিন তদন্ত চলবে, শ্রমিকরা ততদিন খাদ্য ভাতা পাবেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হলে তিনি কাজ ফিরে পাবেন।
জানা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় পোশাক খাতের শ্রমিকরা আবার আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ কারণে গত রোববার গাজীপুরে মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। অথচ এ বিষয়ে একেবারেই নীরব ভূমিকা পালন করছেন মালিকপক্ষ। এতে বিক্ষোভের আগুন আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এই খাতের সংশ্লিষ্টরাই। গাজীপুরের মহাসড়ক প্রায় এক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে পোশাক শ্রমিকরা। তাদের দাবি, গত কয়েক বছর ধরে শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবি করে আসছেন। কিন্তু মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করেন নি। এতে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলছেন, আশুলিয়ায় শ্রমিক ছাঁটাই ও গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। শ্রমিকরা কিছু বললেই তাদের ছাঁটাই করা হচ্ছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন ওয়েবওয়্যার-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেতন বাড়ানোর দাবিতে সামপ্রতিক আন্দোলনের পর শ্রমিক ছাঁটাইয়ে বাংলাদেশে পোশাক খাতে অস্থিরতার আশংকা করা হচ্ছে। এতে ‘আনরেস্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, নির্দোষ গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাউকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে না। যদি এমন কোনো শ্রমিককে পাওয়া যায় যিনি অসন্তোষের সময় সরাসরি কারখানায় ভাঙচুর, লুটপাট বা অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত- তাহলে তাকে চাকরিচ্যুত করা হতে পারে। অন্যথায় নয়।