Home Bangla Recent বিজেএমসিকে পাট দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা

বিজেএমসিকে পাট দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা

দুই বছর ধরে বকেয়া

অর্থ সংকটে কাঁচা পাট সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। করপোরেশনের কাছে গত দুই বছর ধরে সরবরাহ করা পাটের মূল্য এখনো বকেয়া আছে। ফলে বিজেএমসির কাছে এখন আর বাকিতে পাট বিক্রি করতে চাইছেন না ব্যবসায়ীরা। এতে সরকারি পাটকলগুলোর চাহিদা অনুযায়ী পাট কিনতে পারছে না বিজেএমসি। কাঁচামাল সংকটে পাটকলগুলোর উৎপাদন তাই নেমে এসেছে অর্ধেকে। চলতি বছরের মধ্যে এ বকেয়া পরিশোধ না করলে বেশ কয়েকটি পাটকলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই বছরের বকেয়াসহ বিজেএমসির কাছে নিবন্ধিত এজেন্সিগুলোর মোট পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। এ কারণে নিবন্ধিত শতাধিক এজেন্সির মধ্যে অর্ধেক প্রতিষ্ঠানই চলতি অর্থবছরে বিজেএমসিকে কোনো পাট সরবরাহ করেনি। পাওনা আদায়ের জন্য বারবার ধরনা দিয়েও আশ্বাস ছাড়া কিছু মেলেনি তাদের। অন্যদিকে বিজেএমসি বলছে, সরকারের কাছ থেকে বিশেষ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এ অর্থ ছাড় হলে এজেন্টদের পাওনা পরিশোধ করে দেয়া সম্ভব হবে।

জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিজেএমসির পাট ক্রয়ের নিট লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ লাখ ১৪ হাজার ৮২৭ কুইন্টাল। তবে অর্থ সংকটের কারণে ওই বছর করপোরেশনের অধীন মিলগুলো পাট কিনতে পেরেছিল মাত্র ১১ লাখ ৪৬ হাজার ১২০ কুইন্টাল, যার বাজারমূল্য ৫৫২ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পাট ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয় ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৩১ কুইন্টালে। ওই সময়েও বিজেএমসি পাট কিনেছিল ১২ লাখ কুইন্টালের কিছু বেশি, যার অধিকাংশই কেনা হয়েছিল বাকিতে। সার্বিকভাবে দুই অর্থবছরে পাট বিক্রি বাবদ পাটকলগুলোর কাছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা।

চাহিদা অনুযায়ী কিনতে না পারায় কমছে বিজেএমসির অধীন মিলগুলোয় কাঁচা পাটের মজুদ। বিজেএমসির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পাটের মজুদ ছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৮২ কুইন্টাল। জুন থেকে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত পাট ক্রয়ের ভরা মৌসুম থাকে। কিন্তু ওই সময়ে পর্যাপ্ত পাট সংগ্রহ করতে না পারায় ধারাবাহিকভাবে বিজেএমসির পাটের মজুদ কমছে। এর মধ্যে নভেম্বরে মজুদ নেমে আসে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭০৮  কুইন্টালে। ডিসেম্বরে আরো কমে দাঁড়ায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৭০৯ কুইন্টালে। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে বিজেএমসির পাটের মজুদ দাঁড়ায় ১ লাখ ৯ হাজার ৯৭৪ কুইন্টালে।

বিজেএমসিকে দীর্ঘদিন ধরে পাট সরবরাহ করছে রাজবাড়ীর মেসার্স বাঁধন ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী নাদেম দত্ত জানান, তার প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর গড়ে ৭০-৮০ হাজার কুইন্টাল পাট সরবরাহ করছে বিজেএমসিকে। এর মধ্যে গত দুই বছরে সরবরাহ করা পাটের দাম এখনো তাকে পরিশোধ করেনি বিজেএমসি। সব মিলিয়ে করপোরেশনের কাছে বর্তমানে তার পাওনা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি টাকারও বেশি। বাধ্য হয়ে এ বছর পাট সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। মূলত দীর্ঘদিনের সম্পর্কের সুবাদে বিজেএমসিকে এখনো সীমিত পরিসরে কাঁচামাল সরবরাহ করছে তার প্রতিষ্ঠান। মূলধনের বড় একটি অংশ বিজেএমসির কাছে আটকে থাকায় এখন চাইলেও নতুন করে পাট সরবরাহে বিনিয়োগে যেতে পারছেন না তিনি।

একই অবস্থা জামালপুরের মেসার্স হীরালাল ট্রেডার্সেরও। গত দুই অর্থবছরে বিজেএমসির কাছে তার পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। ফলে এ বছর বাধ্য হয়েই পাট সরবরাহ স্বাভাবিকের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে এনেছেন তিনি।

প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মানিক সাহা বলেন, বকেয়া পরিশোধ করা না হলে বিজেএমসিকে আগামীতে আর পাট দেয়ার সুযোগ নেই। এর পরও এখন বকেয়া আদায় ও এজেন্সির লাইসেন্স ধরে রাখতে ব্যাংকঋণ নিয়ে হলেও স্বল্প পরিসরে পাট দিতে হচ্ছে। এ বছর বাকি টাকা না পেলে ব্যবসাই গুটিয়ে নিতে হবে।

বিজেএমসির কাছ থেকে পাওনা আদায়ে পাটমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বকেয়া আদায়ের জন্য বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করেন তারা। ৫ মার্চ ঢাকায় পাট দিবসের প্রাক্কালে এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাটমন্ত্রীর একটি বৈঠক হয়। তবে বৈঠকে এজেন্সিগুলোর বকেয়া পরিশোধ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় উল্লেখ করা হয়নি।

বিজেএমসির ঢাকা জোনের একটি পাটকল বাংলাদেশ জুট মিলস। পাট কেনার জন্য মিলটির সেন্টার রয়েছে ছয়টি। মিলটির কাছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৬৯ লাখ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৪১ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে এজেন্সিগুলোর। এ টাকা পরিশোধ করতে না পারায় এবার এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক পাটও কিনতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। নগদ মূল্যে সীমিত পরিসরে পাট সংগ্রহ করে কোনো রকমে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে কারখানাটি।

একই চিত্র চট্টগ্রামের কেএফডি পাটকলেও। ২০১৩ সালে বেসরকারি খাত থেকে বিজেএমসির কাছে হস্তান্তরের পর পাটকলটি লাভের ধারায় ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে কাঁচামালের অপ্রতুলতায় কাঙ্ক্ষিত উৎপাদনে যেতে পারছে না মিলটি। আগে প্রতিদিন গড়ে ১০ টন পাটপণ্য উৎপাদন হলেও চলতি অর্থবছরে তা নেমে এসেছে অর্ধেকে। প্রায় ৫০০ অস্থায়ী শ্রমিক দিয়ে পরিচালিত মিলটি বর্তমানে দৈনিক গড়ে চার-সাড়ে চার টন পাটপণ্য তৈরি করতে পারছে। মিলে সংরক্ষিত পাটের মজুদও এখন কমতির দিকে। দ্রুত নতুন পাট কিনতে না পারলে উৎপাদন কার্যক্রম দুই শিফটের বদলে এক শিফটে নামিয়ে আনতে হবে বলে আশঙ্কা মিলের পরিচালন বিভাগের কর্মকর্তাদের।

বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদিত পণ্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিক্রি করতে না পারায় পাট সরবরাহকারীদের কাছে করপোরেশনের বকেয়া দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। উৎপাদন ধরে রাখতে পণ্য বিক্রি বাবদ পাওয়া অর্থ দিয়ে নগদে কাঁচা পাট সংগ্রহ করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বাধ্য হয়ে বাকিতে যে পাট কেনা হচ্ছে, তার জন্য দাম ধরতে হচ্ছে বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ার পাশাপাশি চাহিদার বিপরীতে পর্যাপ্ত পাট সংগ্রহ করতে না পারায় চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই অধিকাংশ পাটকলের উৎপাদন কমিয়ে আনা হয়েছে। আগে যেসব মিলে ২৪ ঘণ্টা উৎপাদন হতো, সেগুলোর উৎপাদন বর্তমানে ১৬ ঘণ্টায় নামিয়ে আনা হয়েছে। কাঁচামাল সংকটে অনেক কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম এখন এক শিফটে নামিয়ে আনার কথাও ভাবা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজেএমসির মহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুল মালেক (হিসাব ও অর্থ) বণিক বার্তাকে বলেন, গত দুই বছর পাট খাত সমস্যার মধ্যে ছিল। বর্তমানে বকেয়া পরিশোধে সরকারের কাছে বিশেষ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। সরকার অর্থ ছাড় করলে এজেন্টদের কাঁচামাল বাবদ পাওনা পরিশোধ করে দেয়া হবে। ফলে নতুন করে পাট সংগ্রহের মাধ্যমে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে পারলে দেশের পাট খাত আবারো ঘুরে দাঁড়াবে।

অন্যদিকে পাটপণ্যের বিক্রি এখন বাড়লেও তা এ বকেয়া পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত নয় বলে বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে। যদিও দীর্ঘদিন মন্দার পর হঠাৎ করেই পাটপণ্যের বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় মজুদ পণ্যগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করপোরেশনের বিপণন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। বিপণন বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিজেএমসি দেশী ও আন্তর্জাতিক বাজারে মোট ৩২২ কোটি টাকার পাটপণ্য রফতানি আদেশ পেয়েছে। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ৮৮ লাখ ও ১০ মার্চ পর্যন্ত ২০ কোটি টাকার রফতানি আদেশ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে বিজেএমসির বিপণন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, পাট খাতে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। ফলে পাটপণ্য বিক্রির মাধ্যমে পাওয়া আয় শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাবদই ব্যয় হয়ে যায়। এর পরও বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় পণ্য বিক্রির অর্থ থেকে এ বছর কাঁচা পাটও কেনা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত ডিলাররা বকেয়া থাকার কারণে বাকিতে পাট বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে সবচেয়ে জটিলতার মধ্যে পড়েছে বিজেএমসি নিজে।

জানা গেছে, বিজেএমসির অধীন ২৬টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও তিনটি নন-জুট। এগুলোর মধ্যে ২৪টিই এখন লোকসানে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও বিজেএমসির পাটকলগুলোর (জুট ও নন-জুট) মোট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে বিজেএমসির কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলো যথাসময়ে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারা ও পাট ক্রয়ে নগদ অর্থ সংকটের কারণেই সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে পাটকলগুলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here