মজুরি নিয়ে আন্দোলনের জের ধরে প্রায় ছয় হাজার পোশাকশ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পাশাপাশি বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রচারণা শুরু করেছে ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইনসহ শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। সেটি অব্যাহত থাকলে পোশাক খাত নতুন করে চাপের মুখে পড়বে।
পোশাকশিল্প মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচারণা অব্যাহত থাকলে দেশের পোশাক খাত ভাবমূর্তি-সংকটে পড়তে পারে। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে দুই বছর আগেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সেবার বৈশ্বিক চাপের মুখে মালিকদের পিছু হটতে হয়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মজুরি নিয়ে আন্দোলনের জের ধরে ৫ হাজার ৮৪৫ পোশাকশ্রমিককে আসামি করে ২৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরের কোনাবাড়ী ও গাছা, সাভার, আশুলিয়া ও টঙ্গী পূর্ব থানায় ২৭টি কারখানার করা মামলায় ৪ হাজার ৩৪৫ শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৫১৫ শ্রমিকের নাম উল্লেখ আছে, বাকিরা অজ্ঞাতনামা। সাভার থানায় শিল্প পুলিশের করা এক মামলায় আসামি ১ হাজার ৫০০ অজ্ঞাত শ্রমিক।
গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে মামলাগুলো হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। আবার আন্দোলন করতে গিয়ে ছাঁটাই ও বরখাস্তের শিকার হয়েছেন অনেকে। ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি) সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, ৯৯টি কারখানার ১১ হাজারের বেশি শ্রমিক ছাঁটাই ও বরখাস্ত হয়েছেন। অনেক নিরীহ শ্রমিকের পাশাপাশি ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকেরাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
শ্রমিক সংগঠনের আন্তর্জাতিক জোট ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন (সিসিসি) গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, জেনেভা, বার্লিন, ব্রাসেলস, মাদ্রিদ ও দ্য হেগে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনের সামনে ‘হ্যাশট্যাগ উই স্ট্যান্ড উইথ গার্মেন্ট ওয়ার্কার’ শীর্ষক কর্মসূচি পালন করে। সেখানে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও ছাঁটাইয়ে উদ্বেগ জানায় সিসিসি। ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার ও ছাঁটাইয়ের ঘটনায় আমরা মর্মাহত। শ্রমিকদের মধ্যে যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটি বন্ধ করা উচিত।’
এদিকে পোশাকশিল্পে এখনো শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটছে বলে জানান ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছর আগে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে মাত্র দেড় থেকে দুই হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছিল। সেই তুলনায় এবারের ঘটনা অনেক বড়। তাই শিগগিরই মামলা প্রত্যাহার ও ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের চাকরিতে পুনর্বহাল না করলে পোশাক খাত বড় ধরনের চাপের মুখে পড়বে।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন বা জোট নেতিবাচক প্রচারণা অব্যাহত রাখলে দেশের পোশাক খাতের ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে বলে স্বীকার করেন পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকৃত ঘটনা না জেনেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলো আন্দোলন করছে। আমরা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকে (আইএলও) বিস্তারিতভাবে পুরো ঘটনা জানিয়েছি।’
পোশাকশিল্পের নতুন মজুরিকাঠামো গত ২৪ নভেম্বর ঘোষণা করা হয়। সেই কাঠামোতে নানা অসংগতি থাকায় মজুরিকাঠামো নিয়ে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আন্দোলনে নামেন নারায়ণগঞ্জ ও পরে গাজীপুরের বেশ কিছু কারখানার শ্রমিক। তবে জাতীয় নির্বাচনের পর আন্দোলন জোরালো হয়। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ঢাকার উত্তরার কয়েকটি কারখানার শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামেন। পরে তা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ৮ জানুয়ারি সংঘর্ষের সময় নিহত হন সাভারের উলাইলের আনলিমা টেক্সটাইলের শ্রমিক সুমন মিয়া। ওই দিনই নতুন মজুরিকাঠামোর সমস্যা সমাধানে ১২ সদস্যের একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি পাঁচ দিনের মধ্যে ৬ থেকে ১ নম্বর পর্যন্ত ৬টি গ্রেডে শ্রমিকের মোট মজুরি ১৫ থেকে ৭৪৭ টাকা বৃদ্ধি করে।
শ্রমিকদের বিরুদ্ধে করা ২৮ মামলার এজাহার ঘেঁটে দেখা যায়, বেশির ভাগ কারখানায় মজুরি নিয়ে অসন্তোষ ছিল না। তবে বহিরাগত শ্রমিকেরা এসে সেসব কারখানার শ্রমিকদের কাজ বন্ধ করে আন্দোলনে নামতে বলেন। তাতে রাজি না হলে বহিরাগত শ্রমিকেরা কারখানা ও গাড়ি ভাঙচুর করেন। পরে খোঁজ নিয়ে বহিরাগতদের পাশাপাশি নিজেদের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা করে কারখানাগুলো। সেখানে ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের বেশি আসামি করা হয়। ছোটখাটো ঘটনায়ও মামলা করেছে একাধিক কারখানা। আবার ঘটনার ২৬ দিন পরও দুটি মামলা হয়।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মালিকেরা সুপরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও ছাঁটাই শুরু করেছেন। মালিকেরা নিজেদের পেশিশক্তি দেখানো এবং তাঁরা যে সরকারের মধ্যে আছেন, সেটি দেখানোর জন্যই এমনটি করছেন। তবে এসব কাজ নেতিবাচক হয়েই শিল্পে ফিরে আসে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা কারখানাগুলোকে বলে দিয়েছি, কোনো নিরীহ শ্রমিককে হয়রানি করা যাবে না। শুধু হামলা-ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ থাকলেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তারপরও কোনো নিরীহ শ্রমিক হয়রানির শিকার হয়েছেন, এমন অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
এর আগে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আশুলিয়ায় শ্রমিক আন্দোলন হয়। তখন শ্রমিকদের টানা ধর্মঘটের একপর্যায়ে ৫৯টি কারখানা চার দিন বন্ধ রাখে বিজিএমইএ। পাশাপাশি নয়টি মামলা করে কারখানার মালিক ও পুলিশ প্রশাসন। সেসব মামলায় শ্রমিকনেতাসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো আন্দোলন করে। তাদের প্রচারের কারণে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা অ্যাপারেল সামিট বর্জন করে বিশ্বখ্যাত পাঁচ ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্স, সিঅ্যান্ডএ, নেক্সট ও চিবো। পুরো বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। শেষে সমঝোতায় পৌঁছান মালিকেরা।
মামলায় আছে অসংগতি
মজুরি নিয়ে টানা আন্দোলনের সময় গত ১০ জানুয়ারি টঙ্গী পূর্ব থানায় কারখানা ভাঙচুরের অভিযোগে ৬৫ শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করে টঙ্গী বিসিকের টিভোলী অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষ। মামলার এজাহারে বলা হয়, তাদের কারখানায় মজুরি নিয়ে শ্রম অসন্তোষ ছিল না। তবে ৯ জানুয়ারি সকাল ১০টায় নর্দান করপোরেশন ও নর্দান গার্মেন্টস, তুসুকা গার্মেন্টস, সুমি অ্যাপারেলস, গোল্ড স্টার অ্যাপারেলসহ কয়েকটি কারখানার ১০০-১৫০ জন শ্রমিক টিভোলী কারখানায় এসে কর্মীদের আন্দোলনে নামতে বলেন। টিভোলীর শ্রমিকেরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কাজ করতে থাকলে কারখানা ভাঙচুর করেন বহিরাগতরা।
অবশ্য টিভোলী কারখানার ভাঙচুরের ঘটনায় নর্দানের শ্রমিকেরা ছিলেন না। একই থানায় নিজেদের কারখানায় ভাঙচুরের অভিযোগ এনে নর্দান করপোরেশন ও নর্দান গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষের করা মামলা আমলে নিলে সেটিই প্রমাণিত হবে। এজাহারে বলা হয়েছে, তাদের কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ ছিল না। ৯ জানুয়ারি সকাল ১০টা ২০ মিনিট থেকে ১১টার মধ্যে ২০০-২৭০ বহিরাগত শ্রমিক নর্দান করপোরেশনে ভাঙচুর করেন।১১টা ৩৫ মিনিট থেকে ১২টার মধ্যে নর্দান গার্মেন্টসে ব্যাপক ভাঙচুর চালান বহিরাগতরা।
জানতে চাইলে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়ন রয়েছে টিভোলী অ্যাপারেলে। আন্দোলনের সময় সেই কারখানার নিরীহ পাঁচ শ্রমিককে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনেক শ্রমিক ভয়ে অভিযোগ করছেন না।’
এদিকে গাজীপুরের ইস্টওয়েস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক কর্তৃপক্ষ কারখানা ও গাড়ি ভাঙচুর এবং মালামাল চুরির অভিযোগে ৮ জানুয়ারি গাছা থানায় মামলা করে। এতে ৪৩ শ্রমিককে আসামি করা হয়। পরে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে আনারুল ইসলাম, মাইদুল ইসলাম ও রাজ আহম্মদকে আদালতে পাঠানোর সময় মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা লিখিত দেন, আসামিদের স্বভাবচরিত্র অত্যন্ত খারাপ। তাঁরা শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আখতার বলেন, শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করেন এবং কারখানার মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের প্রিয়ভাজন নন, এমন শ্রমিকদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে হয়রানি করা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মজুরিসংক্রান্ত যৌক্তিক আন্দোলন করেও মামলা ও ছাঁটাইয়ের শিকার হওয়ায় শ্রমিকেরা আতঙ্কে আছেন। যৌক্তিক আন্দোলনের কারণে বহির্বিশ্ব থেকেও প্রশ্ন উঠছে। তাই সরকার ও মালিকপক্ষের উচিত হবে বিশেষ বিবেচনায় মামলাগুলো প্রত্যাহার করা।