লোকসানের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ২২টি পাটকল। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর পাটকলগুলো ৪৬৬ কোটি টাকার লোকসান গুনেছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ৩৯৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। লোকসানের চক্কর থেকে বের হতে না পারায় পাটকলের শ্রমিকদের ৮ থেকে ১০ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া পড়েছে। কর্মচারীরা বেতন পান না তিন মাস।
আবার, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলশ্রমিকেরা বকেয়া মজুরি, মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, বরখাস্ত শ্রমিকদের পুনর্বহাল, মৌসুমে পাট ক্রয়ে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দসহ ৯ দফা দাবিতে ৭২ ঘণ্টার ধর্মঘটে নামায় নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। আর শ্রমিক আন্দোলনের মুখে ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে জাতীয় মজুরি স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী মজুরি নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য গতকাল মঙ্গলবারই সব পাটকলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের লিখিত নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। এটি বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকের মজুরি বেড়ে দ্বিগুণ হবে। তখন পাটকলগুলোর লোকসানও বাড়বে।
তবে গত ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পাট এমন একটি পণ্য, যার কিছুই ফেলনা নয়। অতএব কেন এতে লোকসান হবে? আমি কোনো লোকসানের কথা শুনতে চাই না, বরং পাটশিল্প কীভাবে লাভজনক হবে, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।’
কেন লোকসান
বিজেএমসির কর্মকর্তা ও শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি পাটকলে লোকসানের বড় কারণ কাঁচা পাট কেনায় অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। পাটকলগুলো পাট কেনে দেরিতে ও বেশি দামে। এ ছাড়া সরকারি পাটকলের উৎপাদনশীলতা কম, উৎপাদন খরচ বেশি, যন্ত্রপাতি পুরোনো এবং বেসরকারি খাতের তুলনায় শ্রমিকের মজুরি বেশি। লোকসান ও অব্যবস্থাপনার কারণে শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারে না পাটকলগুলো। অবিক্রীত পণ্য গুদামে পড়ে থাকে। প্রতিবছরই পাটের মৌসুমে কাঁচা পাট কিনতে সরকারের কাছে হাত পাততে হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আর্থিক সংগতি না থাকাসহ কয়েকটি কারণে জাতীয় মজুরি স্কেল এত দিন বাস্তবায়ন করা যায়নি। তবে আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী গতকাল সব পাটকলে মজুরি নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করতে বলেছি। কাজটি শেষ করতে দু–তিন মাস লাগবে। আশা করছি, শ্রমিকেরা কাজে ফিরে যাবেন। অবশ্য নতুন কাঠামোতে শ্রমিকের মজুরি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সেই বাড়তি অর্থের সংস্থানে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে আমরা আলোচনায় বসব।’
বছরের পর বছর ধরে লোকসানের বিষয়ে বিজেএমসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। শিগগিরই পাটের সোনালি ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। গত কয়েক বছর বন্ধ থাকা সিরিয়ার বাজারে ২৫ হাজার বেল পাট রপ্তানির আদেশ মিলেছে। সুদানের বাজারের সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করছি। আশা করছি, দু–চার বছরের মধ্যে অবস্থা ভালোর দিকে যাবে।’
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বিজেএমসির আওতায় ২৬টি পাটকলের মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন–জুট কারখানা। পাটকলগুলোতে গত জুন পর্যন্ত ২৭ হাজার ৭২১ জন স্থায়ী শ্রমিক এবং ৩ হাজার ৭৩০ জন কর্মচারী ও কর্মকর্তা ছিলেন। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত ২৩ হাজার ২৭৮ জন বদলি শ্রমিক ও ৬ হাজার ৫৪৮ জন দৈনিকভিত্তিক শ্রমিক কাজ করেন।
গত অর্থবছরে বিজেএমসির আয় ছিল ১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৪ শতাংশ বা ৬৩৯ কোটি টাকা শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তার মজুরি ও বেতন বাবদ ব্যয় হয়েছে। বর্তমানে শ্রমিকের মাসিক মূল মজুরি ৪ হাজার ১৫০ টাকা। ২০১৫ সালের মজুরি স্কেল বাস্তবায়িত হলে মাসিক নিম্নতম মজুরি ৮ হাজার ৩০০ টাকায় দাঁড়াবে।
আয় কমছে
বিজেএমসির সূত্র জানায়, গত দুই অর্থবছর ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর আয় কমছে। পাট ও পাটপণ্য রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা আয় করে পাটকলগুলো। পরের অর্থবছর সেটি কমে ১ হাজার ১৯০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আর গত বছর আয় হয়েছে ১ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।
পাটকলের লোকসানের জন্য শ্রমিকের অতিরিক্ত মজুরিকেই বেশি দোষারোপ করেন বিজেএমসির কর্মকর্তারা। তবে শ্রমিকের অতিরিক্ত মজুরি নয়, বরং কাঁচা পাট ক্রয়ে অনিয়মকেই দুষলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ–ননসিবিএ ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক সোহরাব হোসেন। তিনি গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভরা মৌসুমে কাঁচা পাটের মণ ছিল এক হাজার থেকে বারো শ টাকা। তখন বিজেএমসি পাট কিনে নাই। দাম বেড়ে যখন দুই হাজার থেকে বাইশ শ টাকা হয়েছে, তখন তারা পাট কিনেছে। সময়ের পাট অসময়ে কিনতে গিয়েই বিজেএমসি কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে লাভ কীভাবে হবে?’
শ্রমিকদের চলমান আন্দোলন নিয়ে সোহরাব হোসেন বলেন, ‘মজুরি না পেয়ে শ্রমিকেরা অমানবিক জীবনযাপন করছেন। অনেকেই অর্ধাহারে–অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। শ্রমিকেরা বাধ্য হয়েই ধর্মঘটে নেমেছেন।’ তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ২০১৫ সালের মজুরি স্কেল বাস্তবায়ন করার পর পাটকলগুলোর আর্থিক অবস্থা আরও নাজুক হবে। সে জন্য বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের জন্য বিশেষ বরাদ্দ করতে হবে।
এদিকে বিজেএমসি লোকসানের কারণে শ্রমিকদের যেমন মজুরি দিতে পারছে না, তেমনি অর্থের অভাবে পাট ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না। গত অর্থবছর সংস্থাটি ২২টি পাটকলের জন্য ২২ লাখ কুইন্টাল কাঁচা পাট কেনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৭১ শতাংশ বা ১৫ লাখ ৬৫ হাজার কুইন্টাল পাট কিনতে সক্ষম হয় বিজেএমসি।
জানতে চাইলে বিজেএমসির চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ নাছিম বলেন, ‘অর্থের অভাবে সময়মতো পাট কেনা যাচ্ছে না। জুলাই মাসে পাট কেনার ভরা মৌসুম, আর আমরা সময়মতো অর্থ না পাওয়ায় তা কিনছি অক্টোবর-নভেম্বরে। তত দিনে দাম বেড়ে যাচ্ছে। বিষয়টি থেকে আমরা বের হওয়ার চেষ্টা করছি।’
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের দাবির একটি মানবিক দিক রয়েছে। সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে বেসরকারি পাটকলগুলো লাভজনকভাবে চলছে। সরকারি পাটকল লাভজনক করতে হলে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাটকলের শ্রমিক সংখ্যা, আকার ও প্রযুক্তির যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। কোনো কোনো মিলের আধুনিকায়ন করতে হবে। কোনোটিকে বাজার চাহিদা অনুযায়ী বিশেষায়িত করতে হবে। আবার মালিকানা সরকারের হাতে রেখে ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে ছাড়া যেতে পারে।