তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রফতানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর নতুন সভাপতি হিসেবে আজ শনিবার দায়িত্ব নিচ্ছেন মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. রুবানা হক। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র এবং বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনিসুল হকের স্ত্রী। বিজিএমইএর ৩৬ বছরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী সভাপতি। পোশাক খাত নিয়ে তার পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন বিষয়ে সম্প্রতি গুলশানে তার বাসায় সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন রুবানা হক। তিনি বলেছেন, পোশাক খাতের ভালো গল্পগুলো তিনি বিশ্ববাসীকে শোনাতে চান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আবু হেনা মুহিব
সমকাল :নির্বাচনী ইশতেহারে আপনি বলেছেন, পোশাক খাত এ মুহূর্তে একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ভাবমূর্তি, পোশাকের দর, রফতানি বাজারকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেবেন- এই ক্রান্তিকাল কী।
রুবানা হক :ক্রান্তিকাল এজন্য বলছি যে, অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো সমস্যায় আছে। শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারছে না। তাদের কষ্ট হচ্ছে। বাজারের চেহারা বদলে গেছে। যারা পোশাক কেনেন, অর্থাৎ ভোক্তাদের রুচি বদলে গেছে। তারা এখন অনেক কম কিনছেন। কিন্তু দামি অর্থাৎ মানসম্পন্ন ভালো পোশাক তারা খোঁজেন। বাজারে দুই ধরনের পোশাকের চাহিদা রয়েছে। একটি হলো, একেবারেই বেসিক অর্থাৎ কম দামের কাপড় এবং মূল্য সংযোজিত বা উচ্চমূল্যের পোশাক। এই মানের পোশাক আমাদের এখানে কম হয়। আমাদের ৩১ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৫ বিলিয়ন শুধু টি-শার্ট পণ্য। কাজেই মূল্য সংযোজিত পোশাকের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এখানে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আবার কিছু নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোই চ্যালেঞ্জ। আবার চ্যালেঞ্জ আছে যেখানে, সেখানে সুযোগও আছে। আমাদের সুযোগ হয়েছে, আমরা চেষ্টা করব।
সমকাল :ভাবমূর্তি সংকটের বিষয়টি?
রুবানা হক :ভাবমূর্তির ঘাটতি কাটাতে নিজেদের গল্পগুলো গুছিয়ে বলতে হবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো আমাদের বিরুদ্ধে যা তা লিখছে। গার্ডিয়ানও সেদিন এরকম একটা রিপোর্ট করেছে। খুবই ভালো একটি কমপ্লায়েন্ট কারখানা, অথচ এটার বিরুদ্ধে যা-তা লিখে দিল। ৪০ লাখ শ্রমিকের শিল্প। সেখানে তো কিছু ভুল-ভ্রান্তি থাকতেই পারে। আমরা যদি ভুল মেনে নিয়ে সেটা ঠিক করতে পারি, তাহলে সম্মিলিত আস্থার জায়গায় আসতে পারি। মিডিয়া, সুশীল সমাজ, মালিক-শ্রমিক এই জায়গাগুলোতে আস্থা অর্জন করা জরুরি। এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। আমার একটাই পরিচয় নয়। আমি কেবল পোশাক কারখানা চালাই তা-ই নয়। আমি লিখি, আমার বিশ্বাসের জায়গা আছে। আমি আনিসের বিধবা স্ত্রী। আমি তার আদর্শ ধারণ করি। আমার পক্ষে কোনো বিচ্যুতিকে প্রশ্রয় দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আমিই খুবই সরল মানুষ, কিন্তু বুঝি কীভাবে এগোতে হবে। আমার মনন আমাকে ধেয়ে বেড়ায়, আমার বিবেক আমাকে ধেয়ে বেড়ায়। আমার পক্ষে কখনও কোনো ফাঁকি হবে না। পোশাক খাতে কোনো সংকট হলে আমাদের ত্রুটি থাকলে আমি ভুল স্বীকার করে মিডিয়ার সহযোগিতা নিতে পারি। আমাদের পোশাক খাতে অনেক ভালো গল্প আছে। আমরা গল্পগুলো বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই, শোনাতে চাই।
দ্বিতীয়ত, আমাদের ২০ ভাগ মাত্র সরাসরি ক্রেতার সঙ্গে কাজ করি, বাকি ৮০ শতাংশ বায়িং হাউসের মাধ্যমে হচ্ছে। এর কারণ, আমাদের দর কষাকষিতে দুর্বলতা আছে। দর কষাকষির জায়গায় আমরা দুর্বল থাকি। এজন্য ক্রেতারা আমাদের চেপে ধরে।
সমকাল :বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষিতে এই দুর্বলতা কেন?
রুবানা হক :আমাদের উদ্যোক্তাদের একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। পাশের কারখানা হয়তো কেউ ১ ডলারে একটা কাজ করে। তার থেকে কমে আমি হয়তো হুট করে ৭৫ সেন্টে কাজ করলাম। এরকম যারা করে তারা মনে করে কারখানার চাকা চললেই হলো। এ শিল্পে ওভার ক্যাপাসিটির সমস্যা আছে। একেক জন ১০০-২০০ লাইনের কারখানা করে বসে আছি। সেরকম কাজ হয়তো সব সময় থাকে না। এখন চাকা সচল রাখতে গিয়ে অসম প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এতে গোটা শিল্পকে মাশুল দিতে হচ্ছে। এ কারণে শ্রীলংকায় বেইজ সিলিং করে দেওয়া হয়েছে। আমরাও সেরকম চিন্তা করছি। কোনো কারখানা দর কষাকষির সহযোগিতা নিতে চাইলে তাদের সহযোগিতা দেব।
সমকাল :দর কষাকষিতে দুর্বলতার ক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় হচ্ছে ভাবমূর্তির দুর্বলতা
রুবানা হক :হ্যাঁ, এই সুযোগটাও নিয়ে থাকে ক্রেতারা। এ জন্য আমরা ভাবমূর্তিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চাই। কারণ, ভাবমূর্তি ঠিক করা গেলে আমরা বলতে পারব, এত বেশি গ্রিন কারখানা কোনো দেশে নেই। আমাদের অনেক ভালো গল্প আছে। মিরপুরের একজন নারী শ্রমিকের আয়ের ওপর পরিবারের ৫ সদস্য নির্ভরশীল। আবার ধরেন, শেয়ারড বিল্ডিংয়ের কারখানাগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অথচ এসব কারখানাকে উদ্যোগ নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে দিলে দর কষাকষিতে শক্তি বাড়বে।
সমকাল :আমাদের মনোযোগ ছিল অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সকে তাড়ানোর দিকে।
রুবানা হক :অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সকে তাড়ানোর পক্ষে আমিও। তারা আমাদের অনেক উপকার করেছে। তবে অ্যাকর্ড নানা ছুতা খুঁজছে। অ্যাকর্ডের নির্বাহী পরিচালক রব অয়েজের ভিসা নেই হয়তো। কাজের অনুমতি হয়তো নেই। তাদের অনেক দুর্বলতা আছে। তারপরও তারা থাকছে ৮টি শর্তের ভিত্তিতে। এই শর্তগুলোর চারটা আমার লেখা। বাকি চারটা মহিউদ্দিন ভাইয়ের (বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি) লেখা। এই শর্ত থেকে আমরা সরব না। এই শর্ত খাড়া থাকলে অ্যাকর্ড কাজ চালিয়ে গেলেও কোনো সমস্যা তৈরি করার সুযোগ থাকবে না। অ্যাকর্ডের অফিসে বিজিএমইএর সেল থাকবে। এই সেল প্রতিদিনের কাজ তদারক করবে এবং আদায় করবে। দুই পক্ষের প্রকৌশলীরা যেকোনো বিষয়ে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেবে।
সমকাল :পোশাক খাত এগিয়ে নিতে আপনার পরিকল্পনা কী?
রুবানা হক :আমাদের গল্পগুলো কখনই গুছিয়ে বলতে পারিনি। আমার পরিকল্পনা আছে, প্রতিটি কারখানার সাধারণ শ্রমিকের গল্পটা সুতায় বেঁধে দিতে পারি কি-না। ছোট একটা বারকোডে ৭ সেকেন্ডের একটা গল্প বলা। ক্রেতারা তা জানুক। এথিক্যাল বায়িং (ক্রয় বাণিজ্যে নৈতিকতা) নিয়ে কথা বলা হচ্ছে, তারা জানুক যদি তারা বাংলাদেশের পোশাক না কেনে তাহলে এই শ্রমিকরা যাবে কোথায়। ক্রেতাদের এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে আমার স্বপ্ন আছে।
আমার আরও কিছু পাগলা স্বপ্ন আছে। আমাকে এমনিতে সবাই শ্রমিকপাগল বলে। ২০ মিলিয়ন ডলারের ওপরে যাদের রফতানি তাদের কারখানায় স্কুল থাকতে হবে। আমি শ্রমিকদের স্বপ্ন দেখাতে চাই। আমি ৫৫ বছরে পিএইচডি করেছি। শ্রমিকরা কেন আরও বড় কাজ করার জন্য এগোতে পারবে না। আমাদের ১৫০ শ্রমিক এখন এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তারা ইংরেজিতে কথা বলতে খুব সাবলীল। আমাকে ইংরেজিতে মেইল করে, কেন ল্যাপটপ দিচ্ছি না। অর্থাৎ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ আছে সামনে। এজন্য শ্রমিকদের তৈরি করতে তাদের পুনঃদক্ষতার সুযোগ দিতে হবে। যদি শ্রমিকদের দিয়ে না পারি, তাহলে তাদের সন্তানদের দিয়ে চেষ্টা করব। এ বিষয়ে সরকারের এটুআই প্রকল্পের সঙ্গে কাজ করার পরিকল্পনা আছে আমার।
সমকাল :তৈরি পোশাকের দুর্বলতার কারণে গোটা রফতানি খাতের মার্কিন জিএসপি স্থগিত করা হয়েছে। এ খাতের উদ্যোক্তা হিসেবে আপনাকে কতটা পীড়া দেয়?
রুবানা হক :ভীষণ পীড়া দেয়। তবে, এই স্থগিতাদেশ মূলত রাজনৈতিক কারণে। কলম্বিয়ার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের দেশের সঙ্গে চুক্তি করে আমেরিকা। অথচ আমাদের জিএসপি স্থগিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদেরও শ্রম-সংক্রান্ত অনেক দুর্বলতা আছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই সেখানে। শ্রমিক ইউনিয়ন কয়টা আছে তাদের।
সমকাল :শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
রুবানা হক :হ্যাঁ, এটা সত্য। মিডলেভেল ম্যানেজমেন্টে আমাদের দুর্বলতা আছে। বিজিএমইএতে এ-সংক্রান্ত কী প্রকল্প আছে সেটা দেখতে হবে। শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য দাবি আদায়ে যা করতে হয় আমি তা করব। আমার কাছে দাবি করতে হবে না। আগেই বলেছি আমার কাছের লোকজন আমাকে শ্রমিকপাগল বলে। সুতরাং তাদের বিষয়ে আমার একটা মমত্ববোধ আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার পর ১ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে সুদে গৃহায়ন ঋণ থেকে শুধু আমি এবং মহিউদ্দিন ভাই ঋণ পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ৫ বছর পরও কাজ না হলে সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। আর একটা কথা বলি, শ্রমিকদের জন্য কোনটা কল্যাণ সেটা বুঝতে হবে। কোনো কিছু গড়তে অনেক সময় লাগে। ধ্বংস করতে লাগে আধা মিনিট। এটা বোঝা দরকার।
সমকাল :স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্থাৎ ২০২১ সালে পোশাক রফতানি থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে কি?
রুবানা হক :রফতানিতো বাড়াতেই হবে। আগামী বছর ৪০ বিলিয়ন এবং পরের বছর ৫০ বিলিয়ন। এটা বাড়ানোর জন্য এক্সিট প্ল্যান করা হবে। যারা টিকতে পারছে না তাদের আইনসম্মতভাবে বিদায় নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। যারা সহযোগিতা দিলে সক্ষমতা বাড়বে তাদের সহযোগিতা দেওয়া হবে। বড় কারখানাগুলোকে উচ্চ মূল্যের পোশাক উৎপাদনে মনোযোগ বাড়াতে হবে। নতুন বাজার বিশেষ করে রাশিয়ায় যেখানে ৪৫ শতাংশ হ্রাস করা কিংবা এরকম অন্যান্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করা, ইউরোপের যে সব দেশে বাজার বাড়েনি সেখানে বাড়ানো। এসব ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করতে হবে। সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আমি কাজ করতে চাই।