তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত ৯৭ শতাংশ শ্রমিক এখনও ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে রয়েছে। শ্রমিকরা শ্রম আইনের শর্ত মেনে আবেদন করলেও অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে তাদের নিবন্ধনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ এমন সব শর্তের বোঝা চাপিয়ে দেয় যা আইন বা বিধিসম্মত নয়, পাশাপাশি শ্রম আইনের স্পিরিট বা মূল চেতনারও পরিপন্থী। সলিডারিটি সেন্টার-বাংলাদেশের এক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
সলিডারিটি সেন্টার-বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে মঙ্গলবার রাজধানীর তোপখানার এশিয়া হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসে ‘সংঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা চর্চায় বাধা : ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক সাক্ষ্যপ্রমাণ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব তথ্য জানানো হয়।
এতে আরও বলা হয়, তৈরি পোশাক শিল্পে সারা দেশে কমপক্ষে ৪ মিলিয়ন বা ৪০ লক্ষ শ্রমিক কর্মরত আছে এবং ২০১৮ সালে এই খাত ৩৩ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ত্রয়োদশ অধ্যায় ‘ট্রেড ইউনিয়ন ও শিল্প সম্পর্ক’-এ রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়নস (আরটিইউ)-এর দফতর থেকে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন করার প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে। ১৭৯ ধারা অনুযায়ী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের জন্য কারখানার ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন প্রয়োজন হয়। ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে শ্রমিকদের ১০৩১টি ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে শ্রম দফতর ৪৬ শতাংশ আবেদনই প্রত্যাখ্যান করেছে। শ্রমিকরা তৈরি পোশাক কারখানায় ইউনিয়ন করার কারণে বরখাস্ত হওয়াসহ প্রতিনিয়ত অসৎ শ্রম আচরণের শিকার হয়, পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা ও ভাড়াটে গুন্ডাদের দ্বারা মৌখিক ও শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়। অল্পসংখ্যক নিয়োগকারী তাদের এই ধরনের বেআইনি আচরণের দায়ে কখনও কখনও জরিমানা বা অন্য কোনো শাস্তির সম্মুখীন হয়।
সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর জন হার্টো। আলোচনা সভায় শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে বাধা ও করণীয় বিষয়ে একটি গবেষণার সারসংক্ষেপ উপস্থাপন সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশ-এর সিনিয়র লিগ্যাল কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট একেএম নাসিম। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আইএলও, তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও বায়ার, বিজিএমই, লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন, জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন ও গার্মেন্টস সেক্টরের ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল এবং শ্রমিক অধিকার বিষয়ে কর্মরত আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের এনজিও প্রতিনিধিরা। সভায় শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে বাধা ও করণীয় বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় এবং শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য অংশগ্রহণকারীরা সুপারিশ প্রদান করেন।
সাধারণত যেসব কারণে নিবন্ধনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয় তার মধ্যে রয়েছেÑ দরখাস্তে প্রদত্ত ইউনিয়ন সদস্যদের স্বাক্ষরের সঙ্গে কারখানা থেকে দেওয়া মজুরি বা বেতন শীটে সেসব সদস্যের স্বাক্ষরের সামান্য অমিল, ইউনিয়নের সদস্যরা নিয়োগকারী কর্তৃক প্রদত্ত কাগজপত্র যেমনÑ পরিচয়পত্র বা পত্রের অনুলিপি দাখিল করতে অসমর্থ হয়, কারখানার পরিচয়পত্রের নম্বরের সঙ্গে কারখানার রেকর্ড বা দলিলপত্রের মিল না থাকা এবং কারখানা কর্তৃক প্রকৃত শ্রমিক সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণ শ্রমিক সংখ্যা দেখানো যেন ইউনিয়নের পক্ষে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন নেই মর্মে দাবি করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ঘুষ লেনদেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব আবেদন প্রত্যাখ্যানের কারণ হয়ে থাকে।
শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা ও ইউনিয়ন নিবন্ধন নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে জরুরিভিত্তিতে কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে বক্তারা উল্লেখ করেন। যেমনÑ কারখানায় মজুরির বিনিময়ে কর্মরত এবং মালিকের সংজ্ঞায় পড়ে না এমন সব কর্মীকে ‘শ্রমিক’ হিসেবে বিবেচনা করা, শ্রমিকদের পরিদর্শনের জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক শ্রমিক রেজিস্টার বা তালিকা সহজলভ্য করা, ইউনিয়ন নিবন্ধনের বিষয়ে রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়নস (আরটিইউ)-এর ‘সন্তুষ্টি’ অবশ্যই বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী নির্ধারিত চাহিদা ও শর্তাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়নসের (আরটিইউ) তদন্ত প্রক্রিয়া সুনির্দিষ্ট আইনগত প্রক্রিয়ায় পরিচালনা করা উচিত এবং ইউনিয়নের বিপক্ষে উত্থাপিত কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ সম্পর্কে জবাব দাখিল ও এর বিপরীতে নিজেদের সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের জন্য ইউনিয়নকে সুযোগ দেওয়া উচিত, ইউনিয়ন গঠন ও নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে আইন ও বিধিমালা সংশোধন করা, ইউনিয়নের পক্ষে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন থাকলে ইউনিয়নকে নিবন্ধন প্রদান করা।