বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির নতুন ‘বিলিয়ন ডলার মার্কেট’-এ প্রবেশ করল সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে প্রান্তিকে জাপানে এক দশমিক ০৩ বিলিয়ন বা ১০৩ কোটি ডলার সমমূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা ও পোল্যান্ডের পর বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির নতুন গন্তব্য বিশ্বের অষ্টম এবং এশিয়ার প্রথম বিলিয়ন ডলার মার্কেট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জাপানের বাজার। এই খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের হিসাবে অচিরেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম প্রধান গন্তব্য হিসেবে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাজারকে ছাড়িয়ে যাবে জাপান।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএ থেকে প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩১ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার বেশি এবং আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বেশি। এই সময় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রধান প্রধান গন্তব্যে কম বেশি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। তবে স্বস্তির বড় কারণ হয়েছে জাপানের বাজারে অবিশ্বাস্য প্রবৃদ্ধি। গত অর্থবছরে জাপানে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৮৪৬ মিলিয়ন ডলার। অথচ চলতি অর্থবছরে মে মাস পর্যন্ত ১১ মাসেই রপ্তানি হয়েছে ১০৩০ মিলিয়ন ডলার। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৩০.৯৬ শতাংশ। জুন মাসের পরিসংখ্যান যোগ হলে স্বাভাবিকভাবে রপ্তানি চিত্র আরো আকর্ষণীয় হবে।
বিজিএমইএসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলায় নিহতদের মধ্যে সাতজন ছিলেন জাপানি নাগরিক। সেই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিকদের বাংলাদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাপান সরকার। সরকারের ত্বরিত পদক্ষেপে দ্রুতই সেই দুঃসহ পরিস্থিতি কাটিয়ে জাপানের আস্থার জায়গায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক রপ্তানি চিত্রে সেই আস্থারই প্রতিফলন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ বছর আগে পোশাকের নতুন বাজার খোঁজার পরামর্শ দিয়ে এই অপ্রচলিত বাজারে পণ্য রপ্তানিতে ৪ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করেন। এর পর থেকে রপ্তানিতে অপ্রচলিত বাজারের হিসসা বাড়তে শুরু করে। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত অপ্রচলিত বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার, যা মোট পোশাক রপ্তানির ১৬.৭৭ শতাংশ। অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ২৩.৮ শতাংশ, যেখানে পোশাক রপ্তানির সার্বিক প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১২ শতাংশ। এই অপ্রচলিত বাজারের সাফল্যের নেতৃত্বে আছে জাপান। মে মাস পর্যন্ত চলতি অর্থবছরে জাপানে সর্বমোট ১২৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে গার্মেন্ট পণ্য ১০৩ কোটি ডলার। নিট পণ্য ৫৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলার আর ওভেন পণ্য ৪৫ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের মধ্যে সর্বোচ্চ টি-শার্ট ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এর পরেই আছে জার্সি। জাপানে গত ১১ মাসে জার্সি রপ্তানি হয়েছে ১৮ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের। এ ছাড়া জ্যাকেট ও ট্রাউজার রপ্তানি হয়েছে ১৭ কোটি ৭৯ লাখ ডলার এবং মহিলাদের জ্যাকেট রপ্তানি হয়েছে ১১ কোটি ১৬ লাখ ডলারের। মূল ক্রেতা জাপানের সবচেয়ে বড় রিটেইল শপ ‘ইউনিকলো’। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই চেইন গ্রুপটি বাংলাদেশের ২৩টির বেশি কারখানার সঙ্গে কাজ করছে।
জাপানের বাজার আরো সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি ও বর্তমান পরিচালক মোহাম্মদ নাছির বলেন, ‘ন্যূনতম মজুরি বাড়ার পর ক্রেতাদের ভালো দাম আশা করেছিলাম। তারা দাম তো বাড়াইনি উল্টো বিভিন্ন বাহানায় কমানোর চেষ্টা করছে। যে কারণে ঈদের আগে একাধিক কারখানা বন্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেদিক থেকে জাপানের ক্রেতারা ব্যতিক্রম। জাপানের ক্রেতারা একটু খুঁতখুঁতে হলেও পণ্যের দাম ভালো দেয়।’ বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি ও ইস্টার্ন অ্যাপারেলসের এমডি নাছির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানা এখন শতভাগ কমপ্লায়েন্স। এটা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের একটা ব্র্যান্ডিং। এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে হাতেনাতে। প্রথমবারের মতো জাপানের বাজারে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।’