Home Apparel বাংলাদেশের গার্মেন্টস হুমকিতে

বাংলাদেশের গার্মেন্টস হুমকিতে

বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের কঠোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে ভিয়েতনামের ফ্রিট্রেড চুক্তি (এফটিএ) সম্পাদনের পর এই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ভিয়েতনাম তার নিকট প্রতিবেশী চীনের বিভিন্ন ধরনের সমর্থন পাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে চীনের কাঁচা মালের সরবরাহ। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশ তার বৈদেশিক বাণিজ্যে মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে। বাণিজ্য বিশ্লেষক ড. জায়েদী সাত্তার মিডিয়াকে বলেছেন, ইউরোপীয় বাজারে ভিয়েতনাম ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এফটিএ-এর আওতায় ভিয়েতনাম যদি ইউরোপীয় বাজারে ‘শূন্য শুল্ক’ সুবিধা পায় তা হলে বাংলাদেশ তার বৃহত্তম বাজারে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়বে। সিপিডির ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমানও মিডিয়াকে বলেছেন, ইউরোপীয় বাজারে ভিয়েতনামের জিরো ট্যারিফ সুবিধা পাওয়া আমাদের জন্য সুখবর নয়। উল্লেখ্য, প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে ভিয়েতনাম ইউরোপীয় ট্রেড কমিশনারের সঙ্গে আলোচনার পর গত ৩০ জুন ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট সম্পাদন করেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অনুমোদনের পর এই চুক্তিটি কার্যকর হতে পারে। এতে করে ভিয়েতনামে বিদেশী বিনিয়োগ আরো বেড়ে যেতে পারে। চীনের কাছাকাছি দেশ হওয়ায় ভিয়েতনাম সুলভে তৈরি পোশাকের কাচামাল আমদানি করতে পারে। অপরদিকে বাংলাদেশের অর্ধকোটি শ্রমিকের কর্মসংস্থানের জায়গা গার্মেন্ট শিল্প  হুমকির মধ্যে পড়বে।

ভিয়েতনাম বনাম বাংলাদেশ

মিডিয়া সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের গার্মেন্টস রফতানি ২০১৭ সালে ছিল $২৮.১৫ বিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনাম এর ছিল $২৫.৯ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া টেক্সটাইল পণ্য রফতানি করে তারা $৩.৫ বিলিয়ন আয় করে।  বাংলাদেশকে প্রায় ধরেই ফেলেছিল ভিয়েতনাম। ২০১৬-১৭ সালে বাংলাদেশের গার্মেন্টস এ রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ০.২% যেখানে ভিয়েতনাম এর প্রবৃদ্ধি ছিল  ৮.৭%। এদিকে ভিয়েতনাম খুব দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে এনেছে। ভিয়েতনামের টার্গেট ২০২০ সালের ভেতর গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল থেকে $৫০ বিলিয়ন ডলার আয় করা। বাংলাদেশের টার্গেট ২০২১ সাল নাগাদ শুধু গার্মেন্টস থেকেই $৫০ বিলিয়ন ডলার আয় করা এবং মোট রফতানি $৬০ বিলিয়ন করা। গত বছরের হতাশাজনক অগ্রগতির পর ধরে নেয়া হয়েছিল হয়ত বাংলাদেশ আর গার্মেন্টস রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না। এরকম চিন্তার যথেষ্ট কারণও ছিল। আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশ এক সময় ছিল দ্বিতীয়। কিন্তু এখন বাংলাদেশের অবস্থান নেমে ৫ এ এসে ঠেকেছে। জিএসপি বাতিল এবং রানা প্লাজা ও তাজরিন ফ্যাশনের মত ঘটনায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল এদেশের গার্মেন্টস। কিন্তু ২০১৭-১৮ সালে এসে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ৮.৭৬% প্রবৃদ্ধি অর্জন করে গার্মেন্টস রফতানি আয় হয়েছে $৩০.৬১ বিলিয়ন ডলার। এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রফতানিতে ২০.০৮% প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এই অর্থবছরের চার মাসে পোশাক খাতে মোট আয় হয়েছে ১ হাজার ১৩৩ কোটি ডলার। রফতানি আয় বেড়েছে ১৯ শতাংশ। এই সময়ে আয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে রফতানি আয় প্রায় ৩১ শতাংশ বেড়েছে। যেটা জুলাই মাসে ছিল ২১%। অর্থাৎ এই অর্থবছরে কোন প্রকার অঘটন না ঘটলে বাংলাদেশ সব মিলিয়ে ১৮-২০%-এর মত প্রবৃদ্ধি অর্জন করলে অবাক হব না। চলতি অর্থবছরে আয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৬৫ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ৫৭ ও আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ৩ হাজার ৬৬৭ কোটি ডলার রফতানি আয় হয়েছিল। প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ।

কিন্তু ভিয়েতনাম পিছিয়ে নেই। চীন আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকেররফতানি বাড়তে থাকে। সেই সাথে ভিয়েতনামের রফতানিও বেড়ে চলেছে। দেশটির এ বছর প্রথম ৩ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৫%। এই হারে বৃদ্ধি পেলেও আশঙ্কা থেকে যায়, যে কোন এক বা দুই বছর বাংলাদেশ এই খাতে খারাপ করলেই ভিয়েতনামের সামনে সুযোগ সৃষ্টি হবে গার্মেন্টস এ বিশ্বে দ্বিতীয় রফতানিকারক দেশ হবার। আমাদের থেকে ভিয়েতনামে সুযোগ সুবিধা বেশি। তাদের লিড টাইম কম। দ্রুত ডেলিভারি দিতে সক্ষম। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো অবকাঠামো খাতে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বন্দরের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। লিড টাইম বেশি লাগে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের উচিত পায়রা বন্দরের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা এবং এই বন্দরকে ঘিরে গার্মেন্টস সিটি করা। চট্টগ্রামেও গার্মেন্টস সিটি করা যায়। সেক্ষেত্রে বে টার্মিনাল এর কাজ দ্রুততম সময়ে শেষ করতে হবে। সেই সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এক্সপ্রেসওয়ে করতে হবে। তাহলে গার্মেন্টস ডেলিভারিতে আমাদের সময় কমে আসবে। এদিকে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কা প্রস্তাব করেছে তাদের বন্দর এবং কারখানা ব্যবহার করতে। অনেক সময় দেখা যায় যে প্রচুর অর্ডার আসলেও দ্রুত ডেলিভারি দিতে না পারা এবং বিপুল অর্ডার প্রস্তুত করার মত অবস্থা এদেশের কারখানার থাকে না। সেক্ষেত্রে তারা শ্রীলঙ্কার কারখানাতে কন্ট্রাক প্রোডাকশন করে এবং সেদেশ থেকে রফতানি করলেও এই বড় অর্ডারটি হাতছাড়া হয়ে অন্য দেশে যায় না। যতদিন আমাদের বড় অবকাঠামোর কাজ শেষ না হবে ততদিন এভাবে বড় এবং বাল্ক এমাউন্টের অর্ডার নেয়া যেতে পারে। সক্ষমতা না থাকলেও শ্রীলঙ্কায় কন্ট্রাক প্রোডাকশন করে যেন হাতছাড়া হওয়া একটা অর্ডারকে ধরে রাখা যায়।

সেই সাথে দরকার ভ্যালু এডেড এবং দামি পণ্য উৎপাদন করা। শুধু এন্ট্রি লেভেলের গার্মেন্টস তৈরি করে বাজারে টিকে থাকা এবং দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। গত বছরের হতাশাজনক পারফরমেন্স হওয়া সত্ত্বেও এবছর যে ১৯% প্রবৃদ্ধি হয়েছে সেটা অনেক বড় কিছু। যদি আগামি ৩ বছর ২০% হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় তবে বাংলাদেশ $৬০ বিলিয়নের রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে। নাহলে আর সেটা সম্ভব হবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here