Home Apparel ব্যাংকিং খাতের ‘শাঁখের করাত’ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প

ব্যাংকিং খাতের ‘শাঁখের করাত’ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প

দেশের বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের হাত ধরে ব্যাংকিং খাতেরও বেড়ে ওঠা। ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের বড় অংশই গেছে এ দুই খাতে। বিতরণকৃত ঋণ ফেরত না পাওয়ার ঘটনাও এ খাতেই বেশি। দেশের শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপির প্রায় ৩১ শতাংশ এ দুই খাতের গ্রাহক। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে বড় যেসব ঋণ কেলেঙ্কারি, তার বেশির ভাগই বস্ত্র ও পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, ২০১৮ সাল শেষে বস্ত্র ও পোশাক শিল্পে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল মোট ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১৭ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এ দুই খাতের মধ্যে আবার ঋণের স্থিতি ও খেলাপি দুটোই বেশি বস্ত্র খাতে। ২০১৮ সালে বস্ত্র খাতে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ১ লাখ ৭ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা খেলাপি। একই সময় পর্যন্ত পোশাক খাতে বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি ৭১ হাজার ৪০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৬ হাজার ২৩০ কোটি টাকা খেলাপি। বাছবিচার বিবেচনা না করে ঋণ বিতরণের কারণে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেশি বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তাদের মতে, নজরদারির ঘাটতিও খাতটিতে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়েছে। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, পোশাক শিল্পে অনেক সময় দেখা যায়, ক্রেতাদের পক্ষ থেকে মূল্য হ্রাসের (ডিসকাউন্ট) চাপ থাকে। অনেক সময় রফতানিকারক দেউলিয়া হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায় চুক্তির ভিত্তিতে ব্যাংকিং হয়েছে, পরে মাস্টার এলসি (মূল ঋণপত্র) আর হয়নি। অর্থাৎ এটা কোনো সরল সমীকরণের ব্যবসা নয়। এখানে ব্যাংকের নজরদারি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন মাস্টার এলসির বিপরীতে কী পরিমাণ ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হয়েছে, এ বিষয়গুলোয় কঠোর নজরদারি রাখতে হয়। এর ব্যত্যয় হলে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের অনেক ঋণখেলাপিই ইচ্ছাকৃত। তবে ব্যবসায়িক পরিস্থিতির কারণেও খেলাপি হয়েছে অনেকে। দেশের বস্ত্র খাতের প্রতিষ্ঠান মুন্নু ফ্যাব্রিকস লিমিটেড শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার চার বছরের মাথায় ২০০০ সালে লোকসানে পড়ে। এতে ব্যাংকঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধে ব্যর্থ হয় মুন্নু ফ্যাব্রিকস। এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি কোম্পানিটি। টানা লোকসান ও গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যায় কোম্পানিটির উৎপাদন। এখন যন্ত্রপাতি চালু রাখার জন্য কোনোমতে উৎপাদন টিকিয়ে রেখেছে কোম্পানিটি। কিন্তু ব্যাংকঋণ আর পরিশোধ করা হয়নি। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত কোম্পানিটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬৭ কোটি টাকা। ২০০৬ সালে সোনালী ব্যাংকের সেরা গ্রাহকের পুরস্কার পেয়েছিল বস্ত্র খাতের কোম্পানি এপেক্স উইভিংস অ্যান্ড ফিনিশিং মিলস লিমিটেড। মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ক্রমন্বয়ে খারাপ হতে থাকে কোম্পানিটির অবস্থা। বিষয়টি আদালতেও গড়ায় একসময়। এ কারণে ব্যাংকের কাছ থেকে নেয়া ঋণ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয় কোম্পানিটি। পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে নতুন প্রকল্পও বাস্তবায়ন করতে পারেনি তারা। ২০০৮ সাল পর্যন্ত মুনাফায় থাকলেও এর পর থেকেই টানা লোকসান দিচ্ছে কোম্পানিটি। নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকঋণও। বস্ত্র খাতের এ প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩০ কোটি টাকা। মুন্নু ফ্যাব্রিকস ও এপেক্স উইভিংসের মতো শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপির তালিকায় আছে বস্ত্র ও পোশাক খাতের মোট ৯২টি প্রতিষ্ঠান। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৭ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা, শীর্ষ ৩০০ গ্রাহকের মোট খেলাপি ঋণের যা ৩৫ শতাংশ। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৫০ থেকে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ রয়েছে বস্ত্র ও পোশাক খাতের ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের। ১০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে, এ খাতের এমন গ্রাহকের সংখ্যা ৪১। ৩০০ কোটি টাকা বা তার বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে বস্ত্র ও পোশাক খাতের ১৮ গ্রাহকের। তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ ঋণখেলাপিও এ খাতের প্রতিষ্ঠান। খেলাপি ঋণ ৩০০ কোটি টাকার বেশি এমন ১৮ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচটিই এনোনটেক্স গ্রুপের। তালিকায় বস্ত্র ও পোশাক খাতের ৯২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম চারটিও এ গ্রুপের। এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িং। সংসদে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৮৪ কোটি টাকা। গ্রুপটির অন্য তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে সুপ্রভ কম্পোজিট নিট লিমিটেড, সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেড ও সিমরান কম্পোজিট লিমিটেড। ৩০০ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ, বস্ত্র ও পোশাক খাতের এমন ১৮ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আরো আছে যথাক্রমে ম্যাক্স স্পিনিং মিলস, বেনটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আলফা কম্পোজিট টাওয়েলস লিমিটেড, আনোয়ারা স্পিনিং লিমিটেড, সুপ্রভ রোটর স্পিনিং লিমিটেড, চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেড, রানকা সোহেল কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস, জ্যাকার্ড নিটেক্স, ইব্রাহিম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, হলমার্ক ফ্যাশন লিমিটেড, পদ্মা পলি কটন নিট ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, ফেয়ার ট্রেড ফ্যাব্রিকস লিমিটেড ও সাহারিশ কম্পোজিট টাওয়েল লিমিটেড। এর মধ্যে সুপ্রভ রোটর স্পিনিং লিমিটেড এনোনটেক্স গ্রুপের, হলমার্ক ফ্যাশন লিমিটেড হলমার্ক গ্রুপের ও সাহারিশ কম্পোজিট টাওয়েল লিমিটেড বিসমিল্লাহ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান। তালিকা অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ ১০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার নিচে, এমন ৪২ গ্রাহকের মধ্যে প্রথমেই আছে ফেয়ার ইয়ার্ন প্রসেসিং লিমিটেড। ফেয়ার ট্রেড গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৯৬ কোটি টাকা। এছাড়া ২৬৭ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আছে এ খাতের প্রতিষ্ঠান মুন্নু ফ্যাব্রিকস লিমিটেডের। বস্ত্র খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান জবা টেক্সটাইলের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০৩ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ ৫০ থেকে ১০০ কোটি টাকার নিচে, বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৩টি। এর মধ্যে মোবারক আলী স্পিনিং মিলস লিমিটেডের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৯৯ কোটি টাকা। এ খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান নোবেল কটন স্পিনিং মিলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৮ কোটি টাকা। শীর্ষ ৩০০ খেলাপি গ্রাহকের মধ্যে ২৮টি তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য। এ সদস্যদের সম্মিলিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। দেশের শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপির তালিকাটি গত ২২ জুন সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তালিকাটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। সংগঠনটির সভাপতি ড. রুবানা হক বণিক বার্তাকে বলেন, শুধু খেলাপি চিহ্নিত করলে হবে না। তালিকায় থাকা সংগঠনের ২৮ সদস্যের মধ্যে ১০০ কোটি টাকার ওপরে ঋণ আছে ছয়-সাত গ্রাহকের। কাজেই আমাদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণগ্রহীতাদের দেখতে হবে। কারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি, তাদের বিষয়টি দেখা সম্ভবত ভালো। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনার পক্ষে বস্ত্র খাতের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনও (বিটিএমএ)। সংগঠনটির সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, তালিকাটিতে বস্ত্র খাতের কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলোর খেলাপি হওয়ার যৌক্তিক কারণ আছে। এ খাতে খেলাপি ঋণ যাতে না হয়, সেজন্য ঋণ বিতরণে সুষ্ঠু নজরদারির প্রয়োজন। তবে তা শিল্পকে বাধাগ্রস্ত করে নয়। কারণ প্রাইমারি টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক খাতে বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকের বড় অংকের বিনিয়োগ আছে। খাত দুটি বাধাগ্রস্ত হলে আমাদের রিজার্ভ সংকুচিত হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here