যুক্তরাজ্যভিত্তিক আয়ারল্যান্ডের পোশাক ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রাইমার্ক। প্রতিষ্ঠানটির কেনা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক সরবরাহ হয় বাংলাদেশ থেকে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের ৯৪টি কারখানা প্রাইমার্কের জন্য পোশাক তৈরি করে। এর মধ্যে কিছু কারখানাকে পোশাক তৈরির ক্রয়াদেশ দেয়া স্থগিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্ট শ্রমিক প্রতিনিধিদের আশঙ্কা, প্রাইমার্কের দেখাদেখি অন্য ক্রেতারাও এ ধরনের স্থগিতাদেশের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রায় ৪৭টি কারখানা সাময়িকভাবে হলেও ক্রয়াদেশ হারাতে পারে।
গত বছর দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমঘন শিল্প পোশাক খাতের নিম্নতম মজুরি হার পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়। ডিসেম্বরে নিম্নতম মজুরির হার ঘোষণা হয় ৮ হাজার টাকা। এ ঘোষণার পর শ্রমিকদের মোট সাতটি গ্রেডের তিনটিতে অসংগতির অভিযোগ এনে আন্দোলন করেন শ্রমিকরা। পরবর্তী সময়ে এ অসংগতি দূর করলেও আন্দোলন চলাকালীন বাধার মুখে পড়তে হয় শ্রমিকদের। অভিযোগ রয়েছে, আন্দোলনে বাধা সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় একজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন ৬৭ জন। কোনো রকম পূর্বঘোষণা ছাড়া চাকরিচ্যুত হয়েছেন ১১ হাজার শ্রমিক।
মালিকপক্ষ কর্তৃক অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত হওয়ার ঘটনাটি স্থানীয় শ্রমিকদের পাশাপাশি আমলে নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার সংস্থাগুলোও। এ ধারাবাহিকতায় চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলো থেকে পোশাক ক্রয়কারী ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় পদক্ষেপ গ্রহণের। মামলা তুলে নেয়াসহ শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবির চাপে কিছু ক্রেতা বিশেষ পদক্ষেপও নিয়েছে। শ্রমিক সংগঠনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রাইমার্ক নিয়মবহির্ভূতভাবে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অভিযোগ তদন্ত শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় ক্রয়াদেশ প্রাপ্তিতে স্থগিতাদেশ পায় কিছু কারখানা।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইটস ফোরামের (আইএলআরএফ) তথ্যমতে, ডিসেম্বরে শ্রমিক আন্দোলনে প্রাইমার্কের জন্য পোশাক তৈরিতে সম্পৃক্ত মোট শ্রমিক ছিলেন ৪২৭ জন। এর মধ্যে ৩৮২ জন শ্রমিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। মোট চারটি কারখানায় কাজ করতেন এ শ্রমিকরা। খাতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রাইমার্কের তদন্তের আওতায় আছে চারটি কারখানার তিনটি।
স্থগিতাদেশের বিষয়টি স্বীকার করে নিলেও স্থগিতাদেশের আওতায় থাকা কারখানার নাম ও সংখ্যা জানাতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করা হয়েছে প্রাইমার্কের পক্ষ থেকে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তাদের হয়ে করপোরেট কমিউনিকেশনের দায়িত্বে নিয়োজিত সিটিগেট ডিউ রজার্সনের কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর নিক রিডিং বণিক বার্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি নিশ্চিত করেন যে গত এপ্রিলে অল্পসংখ্যক কারখানায় স্থগিতাদেশ ঘোষণা দেয়া হয়।
প্রাইমার্কের মুখপাত্রের বরাতে নিক রিডিং বণিক বার্তাকে বলেন, যত্ন নিয়ে আমাদের পণ্য তৈরি এবং শ্রমিকের যথাযথ সম্মান নিশ্চিত করতে আমরা অনেক বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। এ কারণে বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক সরবরাহকারীর ওপর গভীর তদন্ত চলছে। এদের বিরুদ্ধে শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ ছিল। তদন্তকালীন প্রক্রিয়ায় এর আওতাভুক্ত কারখানাগুলোর ওপর স্থগিতাদেশ থাকবে, যার অর্থ নতুন কোনো ক্রয়াদেশ না দেয়া। আমাদের তদন্তে প্রাইমার্কের কিছু আচরণবিধি ভঙ্গ হয়েছে বলে দেখা গেছে। তদন্তের ফলাফল অন্যান্য খাতসংশ্লিষ্টসহ এথিকাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ শীর্ষক উদ্যোগও বিজিএমইএকে জানিয়েছে। প্রাইমার্ক শ্রমিকের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আমরা এ বিষয়ে বিজিএমইএর স্বাধীন অনুসন্ধানকে স্বাগত জানাই।
ডিসেম্বরে শ্রমিক আন্দোলন প্রতিহত করা গত দুই দশকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে সর্ববৃহৎ ঘটনা বলে আখ্যা দিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকার সংস্থা আইএলআরএফ। সংস্থাটির তথ্যমতে, নিয়মবহির্ভূত শ্রমিক ছাঁটাই সংশ্লিষ্ট কারখানার ক্রেতাদের মধ্যে প্রাইমার্ক ছাড়াও আরো আছে সিঅ্যান্ডএ, এইচঅ্যান্ডএম, জারা (ইন্ডিটেক্স), ম্যাঙ্গো, মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার, নেক্সটসহ মোট সাতটি পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড।
আইএলআরএফের দাবি, মোট সাতটি ক্রেতার কাজ করে এমন কারখানাগুলোতে চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া শ্রমিক সংখ্যা ৮ হাজার ৬৮২। এর মধ্যে অভিযুক্ত শ্রমিক রয়েছেন ৪ হাজার ১২৭ জন। শ্রমিক বরখাস্ত ও অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনাগুলোর আওতায় থাকা কারখানা রয়েছে মোট ৪৭টি। এর মধ্যে প্রাইমার্কের সরবরাহকারী কারখানাগুলোসহ বাকি ৪৩টি কারখানাও ক্রয়াদেশ স্থগিতাদেশ পেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকার সংস্থার বাংলাদেশ সহযোগী সংগঠনগুলো।
আইএলআরএফ, ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়াম, ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইনের সঙ্গে শ্রমিক অধিকারসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করে ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন। সংগঠনটির বাংলাদেশ চ্যাপ্টার ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি)। এ সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলছেন, প্রাইমার্কের স্থগিতাদেশের বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবগত নন। তবে সিঅ্যান্ডএ, এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্সের মতো বড় পোশাক ক্রেতা ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে তারা শ্রমিক অধিকার আদায়ের বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করে। পাশাপাশি বাংলাদেশে পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী বিজিএমইএর সঙ্গেও ডিসেম্বরে ছাঁটাই ও অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনায় ভুক্তভোগী শ্রমিকদের অধিকার আদায় নিয়ে কাজ করছে আইবিসি।
আইবিসি প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের ঘটনায় ভুক্তভোগী শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যৌথ কমিটি গঠনের মাধ্যমে কার্যক্রম চলছে। এ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব হবে, ততই তা পোশাক শিল্পের জন্য ইতিবাচক পরিস্থিতি নিয়ে আসবে। এর আগেও শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া শ্রমিকদের বিষয়ে স্থানীয় শ্রমিক সংগঠনের দাবিদাওয়া আমলে না নিলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপের মুখে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। গত ডিসেম্বরের ঘটনার বিষয়গুলোও দ্রুত সমাধান সম্ভব বিজিএমইএর সহযোগিতায়।
আইবিসির সেক্রেটারি জেনারেল সালাউদ্দিন স্বপন বণিক বার্তাকে বলেন, প্রাইমার্ক যদি নিজস্ব তদন্ত কার্যক্রম চালায়, তা শ্রমিকদের জন্য ইতিবাচক। কিন্তু সাময়িকভাবে হলেও কারখানায় কাজ বন্ধ করা কোনোভাবেই ইতিবাচক হতে পারে না। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ছোট বা বড় সব ঘটনাই বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত। তাই ডিসেম্বরে অন্যায়ভাবে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনাটির দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। কারণ এ সমস্যা ঝুলে থাকলে অন্য ব্র্যান্ডগুলোরও প্রাইমার্ককে অনুসরণ করার আশঙ্কা থেকে যায়। বিজিএমইএর সহযোগিতায় এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি, মালিক-শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, প্রাইমার্কের সাসপেনশনের বিষয়টি পুরনো এবং এর কোনো ইমপ্লিকেশন নেই। অন্য কোনো ব্র্যান্ড এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে বলেও আমি মনে করি না। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের অভিযোগের বিষয়টি নিয়ে আইবিসির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছি।