গরিব ও এতিমদের হক চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজি এ বছর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ৩১ বছরের মধ্যে এবার কোরবানির ঈদে কাঁচা চামড়ার দরে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় নেমে আসে। এমন পরিস্থিতিতে ১৩ আগস্ট মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। জানা গেছে, প্রথম ধাপে ‘ওয়েট-ব্লু লেদার’ বা আংশিক প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানিতে উৎসাহিত করা হবে। এরপর অন্যান্য চামড়া রফতানির সুযোগ দেয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ দেয়া হলে গরিব-দুঃখী মানুষ চামড়ার ন্যায্য মূল্য পাবেন। ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের সিন্ডিকেটে কাঁচা চামড়ার দাম নিয়ে কারসাজির লাগাম টানা যাবে। এ খাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে। চামড়াজাত পণ্যের ব্যবসা প্রসারের সুযোগও তৈরি হবে। বিশ্বব্যাপী ২২ হাজার কোটি ডলারের বেশি চামড়া রফতানি বাজারে বাংলাদেশের হিস্যাও বাড়বে। বাণিজ্য সচিব মো. মফিজুল ইসলাম জানান, ট্যানারির মালিকরা কারসাজি করে সরকারের বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে কমে কিনলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ রাখা হবে। প্রথম ধাপে ওয়েট-ব্লু রফতানিতে উৎসাহিত করা হবে। এরপর অন্যান্য চামড়া রফতানির সুযোগ দেয়া হবে। দেশ থেকে কাঁচা চামড়া কখনও রফতানি না হলেও এক সময় ‘ওয়েট-ব্লু লেদার’ (রাসায়নিক দিয়ে চামড়াকে পশম ও ঝিল্লিমুক্ত করা) রফতানি হতো। কিন্তু দেশীয় পাদুকা ও চামড়াজাত অন্যান্য শিল্পের বিকাশের কথা বিবেচনায় নিয়ে ১৯৮৯ সালে তাও নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর থেকেই কারসাজির মাধ্যমে চামড়ার দাম কমিয়ে মুনাফা করছে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ট্যানারি শিল্প মালিক থেকে শুরু করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। নব্বইয়ের দশক থেকেই আড়তদাররা ট্যানারির মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। পাইকার ও আড়তদারের প্রচুর অর্থ তাদের কাছে আটকে আছে। ট্যানারির মালিকরা হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্প নগরে নেয়া এবং রফতানি কমে যাওয়ার অজুহাতে ঈদের আগে পাওনা টাকা ১-৫ শতাংশের বেশি পরিশোধ করেননি। বকেয়া টাকা শিগগিরই পাওয়ার আশাও কম। অনিশ্চয়তার কারণে নিজের গাঁটের টাকা বিনিয়োগ করেননি অধিকাংশ আড়তদার। তাই চামড়ার দামে ব্যাপকভাবে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দু-তিন বছর ধরেই কাঁচা চামড়ার দামে ধস নামলেও এ বছর অবস্থা চরম খারাপ পর্যায়ে পৌঁছায়। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর যদি কার্যকর ব্যবস্থা নিত তাহলে বিপর্যয় ঠেকানো যেত বলে মনে করেন তারা। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় সম্পদ রক্ষা ও ট্যানারি মালিকদের একচেটিয়া বাণিজ্য ভেঙে দিতে এবং বেশি দামের আশায় পাচার বন্ধ করতে কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর করা উচিত। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি আমলে নেয়া সঠিক হবে না। কারণ অতীত অভিজ্ঞতায় বলে, কাঁচা চামড়া রফতানির উদ্যোগ আগেও নেয়া হয়েছিল। তখন ট্যানারি মালিকরা দাম বাড়িয়ে এ উদ্যোগ ঠেকিয়ে দিয়েছে। এবার যেন তেমনটি করা না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। জানা গেছে, দেশীয় শিল্পের কথা বিবেচনায় নিয়ে নব্বইয়ের দশকে কাঁচা চামড়া রফতানি নিষিদ্ধ করে কেবল ফিনিশড লেদার বা প্রক্রিয়াজাত চামড়া রফতানির অনুমোদন রাখা হয়। এ সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর চামড়ার দামে কারসাজি করে আসছে। এ ক্ষেত্রে ট্যানারি শিল্প অন্যান্য শিল্পের মতো প্রতিযোগিতামূলক না হয়ে সীমিত কিছু ব্যবসায়ীর হাতে বন্দি থাকার দায়ও রয়েছে। ফল হিসেবে প্রতিবেশি দেশ ভারতে যেখানে প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়ার দাম ১১০-১২০ টাকা এবং অন্যান্য দেশে এ দাম ২৪০-২৫০ টাকা, সেখানে আমাদের দেশে তা মাত্র ৪০-৪৫ টাকা! ট্যানারি মালিকদের দাবির মুখে সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করে দেয়া এ দাম দিতেও অনীহা। নানা কারসাজি করে পানির দরে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ অবস্থায় কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর করতে হবে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।