প্রাকৃতিক কারণে এ দেশের পশুর চামড়া গুণগত মানসম্পন্ন। এসব চামড়া থেকে উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমিকের মজুরি কম হওয়ায় চামড়া খাতে উৎপাদন ব্যয় কম। অন্যদিকে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চীনে চামড়ার ব্যবসা সংকুচিত হয়ে আছে। বিকল্প বাজার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় বাংলাদেশ থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্ডার আসছে না। এর মূল কারণ, এ দেশের অনেক চামড়া ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের শর্ত অনুযায়ী কারখানায় পরিবেশের মানদণ্ড বজায় রাখতে পারছেন না। চামড়া শিল্পসংশিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, কারখানায় আন্তর্জাতিক পরিবেশ মান বজায় রাখতে সক্ষম হলে তৈরি পোশাক শিল্পের মতো এ দেশের চামড়া খাতও শীর্ষ বাণিজ্য পণ্যের তালিকায় চলে আসবে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শ্রমঘন শিল্প হিসেবে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে চামড়া খাতের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে অর্থনীতিতে। চামড়া খাত এগিয়ে গেলে এ দেশের অর্থনীতিও অনেকটা এগিয়ে যাবে। অথচ পরিবেশবান্ধব কারখানায় উৎপাদন করতে না পারায় প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ভালো বিক্রি হচ্ছে না।’ এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘পরিবেশ মানদণ্ড বজায় থাকলে এলডাব্লিউজি গ্রুপের সার্টিফিকেট মিলবে। এতে চামড়া খাতের সকল প্রতিবন্ধকতা কাটবে। এ সার্টিফিকেট পেতে হলে কারখানায় অবশ্যই বর্জ্য শোধনাগার থাকতে হবে। এ শর্ত অনেক ট্যানারি পূরণ করতে পারছে না। এখানেই এখন নজর দিতে হবে। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ও চামড়া খাতের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। এই দল সমগ্র চামড়া খাতের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানে সুপারিশ করবে।’ চামড়া প্রক্রিয়াকরণে এ দেশের অল্প কিছু ট্যানারির মালিক নিজস্ব উদ্যোগে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করেছেন। তবে এ সংখ্যা সীমিত। এ দেশের ট্যানারির অধিকাংশই রয়েছে সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে। এখানে কেন্দ্রীয়ভাবে বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সিইটিপির নির্মাণ ব্যয় বহন করছে সরকার। এ সিইটিপি সম্পূর্ণ চালু এবং পরিচালনাজনিত ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখা সম্ভব না হলে পণ্য রপ্তানিতে গতিশীলতা আসবে না—এমন মত জানিয়ে বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে এ দেশের ৯৫ শতাংশ ট্যানারি গড়ে উঠেছে। এখন চামড়া খাতে পরিবেশের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। সাভার চামড়া শিল্প নগরীর পরিবেশে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড না থাকলে এখানকার কারখানা থেকে কোনো পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে না। এখনো এখানকার সিইটিপি ও পরিবেশ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছেনি। এ বিষয়ে সরকার ও বেসরকারি খাতকে নজর দিতে হবে। না হলে সম্ভাবনাময় চামড়া খাতে ভয়াবহ সমস্যা তৈরি হবে।’ চামড়া খাতের বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের তৈরি প্রতিবেদনে চামড়া খাতের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে—‘চামড়াশিল্প দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে তৈরি পোশাকের পরই এ শিল্পের অবস্থান। এর কাঁচামালেও বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। এ ছাড়া এ খাতে ৬০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের সুযোগ রয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ এ শিল্প খাতে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। বর্তমানে বিশ্ববাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ২২০ বিলিয়ন ডলারের বাজার থাকলেও বাংলাদেশ এ খাতে মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে থাকে। রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশি চামড়াশিল্পের বিশাল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারি-বেসরকারি খাতকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।’