প্রচলিত বাজারের বাইরে নতুন বাজার খোঁজায় সফলতা আসছে দেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাকে। বিভিন্ন দেশের নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) এ বাজারগুলোতে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৬৮ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার। অথচ গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৫২ কোটি ৬১ লাখ ৯০ হাজার ডলার। পোশাক রপ্তানিতে প্রণোদোনা ও শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের নতুন বাজারগুলোতে রপ্তানি বাড়তে সফল হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় দেশগুলো পোশাক রপ্তানির প্রচলিত বাজার হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এর বাইরে চিলি, চীন, জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো, তুরষ্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা ও রাশিয়ার বাজারগুলোকে পোশাক রপ্তানির নতুন বাজার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানি গাণিতিক হারে বাড়ছে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানান, সরকার ২০১০ সালে সরকার অপ্রচলিত বাজারগুলোতে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদোনা ঘোষণা করেছিল। অবশ্য ২০১৮ সালে তা ৪ শতাংশ করা হয়। শুরুর দিকে তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা নানা বাধা-বিপত্তির কারণে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। একজন ব্যবসায়ীকে নতুন বাজারে যেতে হলে নতুন নতুন মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে হয়, প্রচুর গবেষণা ও বাজারে ঝুঁকির কথা চিন্তা করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, যখন একজন ব্যবসায়ী নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি করতে যান, তাকে প্রচলিত গড় দামের চেয়েও কম দামে পোশাক রপ্তানি করতে হয়। সরকার কিছু সময় পর্যন্ত পোশাকে নগদ প্রণোদোনা ঘোষণার পর ব্যবসায়ীরা এখন নতুন বাজার খোঁজা শুরু করেছেন। মোট রপ্তানি আয়ের ১৫ থেকে ১৬ শতাংশই আসে নতুন বাজারগুলোতে পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে। এর পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মাসে শুধু চীনের বাজারে ৮ কোটি ৫০ লাখ ৭০ হাজার ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৭ কোটি ৯২ লাখ ২০ হাজার ডলার। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার চীনে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় পোশাক সরবরাহকারী দেশ। দেশটি বাংলাদেশের ৫ হাজার পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার পর পোশাক রপ্তানির পরিমাণও বাড়ছে। দেশটির ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষই মধ্যম আয়ের।
চলতি বছরের আলোচিত এই সময়ে ভারতের বাজারে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১১ কোটি ২৬ লাখ ৩০ হাজার ডলারের। গত বছর একই সময়ের ভারত থেকে পোশাকে রপ্তানি আয় ছিল ১০ কোটি ১৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশটিতে পোশাকের রপ্তানি আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ।
পোশাকের আরেক নতুন বাজার চলতি অর্থবচরের প্রথম দুই মাসে রপ্তানি হয়েছে ১৯ কোটি ৩৩ লাখ ৬০ হাজার ডলারের। গত বছরের একই সময়ে দেশটিতে এ খাতের রপ্তানি হয়েছিল ১৬ কোটি ৪৪ লাখ ২০ হাজার ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ।
মেক্সিকোতে আলোচিত সময়ে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪ কোটি ডলারের। অথচ গত বছরের একই সময়ে দেশটিতে এ খাতের রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। বছরের ব্যবধানে দেশটিতে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন বু্রোর (ইপিবি) তথ্য মতে, গত অর্থবছরে বিশ্বের এসব নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫৬৮ কোটি ৭১ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগের অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৬৭ কোটি ডলারের। ফলে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ বা ১০২ কোটি ডলারের। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। এসব বিবেচনায় নতুন বাজারে রপ্তানি আশাব্যঞ্জক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষত নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়াতে সরকারের দেয়া প্রণোদনা এবং কিছু বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা রপ্তানি বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন তারা। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে। সবার ওপরে চীন। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ছিল ১ হাজার ২৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সেই রপ্তানি বেড়ে ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ১০ বছরে রপ্তানি বেড়েছে ১৪৮ শতাংশ বা ২ দশমিক ৪৮ গুণ। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির শীর্ষ বাজার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর জার্মানি সেই অবস্থান দখল করে নিয়েছে। তবে রানা পস্নাজা ধসের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি কমছিল। গত বছরের জানুয়ারিতে এই বাজারেও ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। নতুন নতুন ক্রেতা পোশাকের ক্রয়াদেশ নিয়ে আসছেন। পুরোনো ক্রেতারাও ক্রয়াদেশ আগের চেয়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও পোশাকের রপ্তানি বাড়ছে।