ছেলে ও মেয়েদের শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি-শার্ট ও সোয়েটার থেকে দেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানির ৬১ শতাংশ অর্থ আসে। আবার পোশাকশিল্পের রপ্তানির ৭৩ শতাংশই এই পাঁচ পণ্যের দখলে। সব মিলিয়ে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য অনেকটাই পাঁচটি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে পোশাক খাতের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলার। এই রপ্তানির ৭২ দশমিক ৯৫ শতাংশ বা ২ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার এসেছে শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি–শার্ট ও সোয়েটার রপ্তানি থেকে। দেশে সস্তা পণ্যের পাশাপাশি বেশি দামের বা ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য যেমন স্যুট, ব্লেজার, অন্তর্বাস, সাঁতারের পোশাক উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে সেটি এখনো বড় আকার ধারণ করেনি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পোশাক খাতের রপ্তানির ৭৮ শতাংশ শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি–শার্ট ও সোয়েটার থেকে এসেছিল। গত পাঁচ বছর পর সেটি কিছুটা কমে ৭৩ শতাংশ হয়েছে। পোশাকশিল্পের কয়েকজন উদ্যোক্তা বলছেন, বিদেশিরা যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই বাংলাদেশে পোশাকশিল্প বেড়ে উঠেছে। তার মানে, সস্তা পোশাকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন দেশের উদ্যোক্তারা। তবে গত কয়েক বছরে শ্রমের মজুরি, গ্যাস-বিদ্যুৎ, ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাতে সস্তা পোশাক উৎপাদনকারীরা চাপে পড়েছেন। তাঁদের মুনাফাও কমেছে। ভবিষ্যতে পোশাক রপ্তানিকে টেকসই করতে হলে প্রধান পাঁচ পণ্যের পাশাপাশি বেশি দামের পোশাক তৈরির দিকেও যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ, বিশেষ করে চীনাদের আকৃষ্ট করতে হবে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, পাঁচ পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় টি-শার্ট। গত অর্থবছরে ৭০১ কোটি ডলারের বা ৫৯ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকার টি-শার্ট রপ্তানি হয়েছে। সেই হিসাবে টি-শার্টে রপ্তানি বেড়েছে ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দেশের মোট পণ্য রপ্তানির ৬১ শতাংশই শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি-শার্ট ও সোয়েটারের দখলে শুধু পোশাক রপ্তানির মধ্যে সেটি ৭৩ শতাংশ টি-শার্টের পরই বেশি রপ্তানি হয় ট্রাউজার। গত পাঁচ বছরে ট্রাউজারের রপ্তানি বেড়েছে ১২৫ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে ৬৯৪ কোটি ডলারের ট্রাউজার রপ্তানি হয়েছে। এই আয় তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। তৃতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি পণ্য জ্যাকেট। তিন বছর ধরে জ্যাকেটের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। গত অর্থবছর ৪৩৮ কোটি ডলারের জ্যাকেট রপ্তানি হয়েছে। তার আগের ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৩৯৭ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত অর্থবছরে পণ্যটির রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৩২ শতাংশের মতো। অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে সোয়েটার রপ্তানি ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যেখানে ২৮২ কোটি ডলারের সোয়েটার রপ্তানি হয়েছিল, সেখানে গত অর্থবছরে তা বেড়ে ৪২৫ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এটি আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি। গত পাঁচ বছরে টি-শার্ট ও সোয়েটার রপ্তানি ব্যাপক হারে বাড়লেও শার্টের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এই সময়ে শার্ট রপ্তানি মাত্র ৫ কোটি ডলার বেড়েছে। গত অর্থবছরে ২৩২ কোটি ডলারের শার্ট রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ২০৬ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত অর্থবছর শার্ট রপ্তানি বেড়েছে ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। ক্ল্যাসিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদউল্লাহ আজিম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেবল পাঁচটি আইটেমের ওপর নির্ভরশীলতা পোশাকশিল্পের জন্য ভালো খবর নয়। পোশাক রপ্তানিকে টেকসই করতে হলে সস্তা ও বেশি মূল্যের পণ্যের রপ্তানি সমান সমান করতে হবে। আমাদের কয়েকজন উদ্যোক্তা ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য উৎপাদন শুরু করেছেন। তবে সেটি ব্যাপক হারে করতে হলে বিদেশি উদ্যোক্তাদের আনতে হবে।’ শহিদউল্লাহ আজিম আরও বলেন, ‘বৈচিত্র্যময় ও ভ্যালু অ্যাডেড পোশাক উৎপাদনে চীন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে দেশটি থেকে অনেক পোশাক কারখানা ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে আসছে মাত্র দুটি। তাই চীনা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সরকারের আরও তৎপর হওয়া দরকার।’ অবশ্য সস্তা পোশাকেও বাড়তি মূল্য সংযোজনের সুযোগ আছে বলে মনে করেন বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফয়সাল সামাদ। তিনি বলেন, ‘শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি-শার্ট ও সোয়েটার আমাদের পোশাকশিল্পের জন্য বড় শক্তি। এসব পণ্যেও মূল্য সংযোজনের সুযোগ আছে। বৈচিত্র্যময় কাপড় ও নকশা ব্যবহারের মাধ্যমে সস্তা টি-শার্টও দামি হয়ে ওঠে। পণ্যের উন্নয়নে প্রতিনিয়ত গবেষণার পাশাপাশি বাজারের গতিধারারও খোঁজ রাখতে হবে।