ক্রয়াদেশ সংকটে ছোট কারখানা বন্ধ হচ্ছে। কমছে বড়দের ক্রয়াদেশও। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে পড়েছে পোশাক রফতানি। টাকার অতি মূল্যায়নকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। তাদের দাবি, ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ায় রফতানির বিপরীতে কম অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। এ থেকে উত্তরণে সর্বোচ্চ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার সমর্থন চেয়েছেন পোশাক শিল্পের প্রতিনিধিরা।
আর্থিক সুবিধার বিষয়টি উল্লেখ করে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি ড. রুবানা হক স্বাক্ষরিত চিঠিতে পোশাক শিল্পের মন্দা মোকাবেলায় মোট ১৪টি সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সর্বপ্রথম যে সুবিধাটি চাওয়া হয়েছে, তা মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত। সেখানে বলা হয়েছে, কাঁচামাল আমদানি ও অন্যান্য ব্যয়ের পর রফতানীকৃত পোশাকের বিপরীতে প্রাপ্ত মূল্যের ২৫ শতাংশ ধরে রাখতে পারেন উদ্যোক্তারা। এ ২৫ শতাংশের ওপর ডলারপ্রতি অতিরিক্ত ২ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত চেয়েছেন পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা।
২০১৮-১৯ অর্থবছর পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৩৪ বিলিয়ন (৩ হাজার ৪০০ কোটি) ডলার। চলতি অর্থবছর ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রফতানি প্রক্ষেপণ করা হয়েছে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলারের। ২৫ শতাংশ হিসাবে ৩৭ বিলিয়ন ডলারে মূল্য সংযোজনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯২১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এর ওপর ডলারপ্রতি অতিরিক্ত ২ টাকা দেয়া হলে তহবিলের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা। ডলারপ্রতি ৩ টাকা অতিরিক্ত দিলে তহবিলের আকার দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। ৪ ও ৫ টাকা অতিরিক্ত দেয়া হলে তহবিলের আকার দাঁড়াবে যথাক্রমে ৩ হাজার ৬৮৬ ও ৪ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে সর্বনিম্ন ১ হাজার ৮৪৩ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা চেয়েছে বিজিএমইএ।
জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বণিক বার্তাকে বলেন, গত ছয় মাসে ৫৯টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। চাকরিচ্যুত হয়েছেন ২৫ হাজারের বেশি শ্রমিক। কারখানায় ক্রয়াদেশ কম। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বেশকিছু সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
পোশাক শিল্পে মন্দার কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই তাত্পর্যহীন রফতানি প্রবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছে বিজিএমইএ। গভর্নরের কাছে পাঠানো চিঠিতে সংগঠনটি উল্লেখ করেছে, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে পোশাক রফতানি কমেছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। গত চার অর্থবছর মূল্য সংযোজনও কমেছে ১ দশমিক ৬১ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা দুর্বল হওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে।
তবে বিজিএমইএ সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর। গত আট বছরে বাংলাদেশ ও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে সংগঠনটি বলেছে, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে এক ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী মুদ্রার মান ছিল ৮০ দশমিক ৫১ টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ দশমিক ৮৭ টাকায়। মুদ্রা বিনিময় হারে পরিবর্তন হয়েছে ২ দশমিক ৯২ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়সীমায় পাকিস্তান, ভারত, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, চীন ও শ্রীলংকায় মুদ্রা বিনিময় হারের পরিবর্তন হয়েছে যথাক্রমে ৬৬ দশমিক ৪০, ৩৫ দশমিক শূন্য ৩, ২১৮ দশমিক ৭, ১০ দশমিক ৯৯, ১২ দশমিক ৬২ ও ৩৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
এসব বিবেচনায় পোশাক শিল্পের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রণোদনা প্যাকেজের প্রস্তাব দিয়েছে বিজিএমইএ। এর প্রথমেই আছে আরএমজি ফরেন কারেন্সি রিয়ালাইজেশন প্রোগ্রাম (আরএফসিআরপি)। এর আওতায় মূল্য সংযোজনের ওপর ডলারপ্রতি অতিরিক্ত টাকা দাবি করেছে তারা।
মুদ্রা বিনিময় হারে অতিরিক্ত টাকার পাশাপাশি ঋণ পুনঃতফসিল, প্যাকিং ক্রেডিট, অগ্রিম মূল্য পরিশোধের সীমা বৃদ্ধি, স্ট্যাম্প ডিউটি কমানো, এক অংকের সুদে ব্যাংকঋণ, রফতানি উন্নয়ন তহবিলের সুদ হার হ্রাস এবং বিদেশী মুদ্রায় চলতি মূলধন প্রাপ্তির সুবিধাও চেয়েছে সংগঠনটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক এসব প্রস্তাব গ্রহণ করলে পোশাক খাতের মন্দা কাটানো সহজ হবে বলে মনে করেন বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সুপারিশগুলো গ্রহণ করা হলে কিছুটা হলেও প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার পরিস্থিতি তৈরি হবে। কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশনের কারণে আমাদের প্রতিযোগী সব দেশই ভালো অবস্থানে আছে। কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশনের কারণে ক্রয়াদেশও এসব দেশে চলে যাচ্ছে।
ক্রয়াদেশ ঘাটতিতে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম হয়েছে। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বব্যাপী পোশাক রফতানি হয়েছে ৮০৫ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ৮১৯ কোটি ১৬ লাখ ডলারের পোশাক। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রধান দুই বাজারেই পোশাকের রফতানি কমেছে।