দেশের রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসছে তৈরী পোশাক শিল্পখাত থেকে। শিল্পখাতে কর্মসংস্থান হওয়া শ্রমিকদের দুই-তৃতীয়াংশ কাজ করছে এ খাতে। প্রিন্টিং, প্যাকেজিং, বোতাম, জিপার, লেবেল, ট্যাগ, কার্টুন থেকে শুরু করে শত শত শিল্পের সাফল্য নির্ভর করছে পোশাকের ওপর। পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীলতা আছে বৃহদাকার তুলা, সুতা, টেক্সটাইল, ডায়িং, উইভিং প্রভৃতি শিল্পেরও। ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও টিকে আছে তৈরী পোশাক শিল্পকে ঘিরে। সঙ্গত কারণেই পোশাক শিল্পে কোনো সঙ্কট দেখা দিলে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় সংশ্লিষ্ট অগ্র ও পশ্চাদ শিল্পগুলোয়। ঝুঁকিতে পড়ে সামগ্রিক অর্থনীতি। এরই মধ্যে বিপত্তি ঘটিয়েছে সরকারের একটি সিদ্ধান্ত। চলতি অর্থবছরের বাজেটে পোশাকসহ সব খাতের উৎসে কর ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।
এতে হোঁচট খায় শিল্প। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার শেষ পর্যন্ত নিজ অবস্থান থেকে ফিরে আসে। ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে উৎসে কর দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়। গত ২১ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারির দিন থেকেই তা কার্যকর করা হয়। যদিও তৈরী পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ চায়, তা যেন ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়। তৈরী পোশাক খাতের চলমান দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) লেখা এক চিঠিতে বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক এ দাবি জানান। বিজিএমইএর ওই চিঠিতে রফতানি পোশাক খাতের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, দেশের প্রায় ৮৪ শতাংশ রফতানি আয় অর্জনকারী এই শিল্পটি বর্তমানে দেশ-বিদেশে নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বর্তমানে পোশাকশিল্প ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহত দরপতন, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে ব্যবসায় পরিচালনা ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের রফতানি পর্যালোচনায় দেখা যায়, মোট রফতানি হয়েছে চার হাজার ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য। এই আয় আগের অর্থবছরে রফতানি হওয়া তিন হাজার ৬৬৬ কোটি ডলারের চেয়ে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। তা ছাড়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ রফতানি বেশি হয়েছে বিদায়ী অর্থবছরে। এ বছর রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশ পোশাক খাত থেকে এসেছে। সব মিলিয়ে বছরটিতে তিন হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের তৈরী পোশাক রফতানি হয়েছে। এই আয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। আর বিদায়ী অর্থবছরের পোশাক রফতানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি। আবার পোশাকশিল্পের মধ্যে ওভেন পোশাক রফতানি হয়েছে এক হাজার ৭২৪ কোটি ডলারের। প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্য দিকে নিট পোশাক রফতানি হয়েছে এক হাজার ৬৮৮ কোটি ডলারের। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ।
বিদায়ী অর্থবছরে পোশাকের বাইরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০১ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের রফতানি আয় এসেছে চামড়া খাত থেকে। দীর্ঘ দিন ধরে খাতটির রফতনি আয় নিম্নমুখী। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়া পণ্যের রফতানি কমেছে ৬ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৯০ কোটি ৮৯ লাখ ডলারের রফতনি আয় এসেছে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য থেকে। এই আয় গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি। এ বছর চামড়া ও চামড়া পণ্য, পাট ও পাট পণ্য, হোম টেক্সটাইল এবং হিমায়িত চিংড়ি রফতানি কমেছে। আর বেড়েছে তৈরী পোশাক, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, টেরিটাওয়েলে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের তিন প্রধান রফতানি পণ্য পাট, চা ও চামড়ার অবস্থা দিন দিন হতাশাজনক পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে পোশাক রফতানি ছিল মাত্র তিন কোটি মার্কিন ডলারের। ২০০৯-১০ অর্থবছরে সেটি বেড়ে হয় এক হাজার ২৪৯ কোটি ডলারে। গত অর্থবছর পোশাক রফতানি হয় তিন হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের। তার মানে ৩৬ বছরের ব্যবধানে পোশাকের রফতানি বেড়েছে এক হাজার ১৩৩ গুণ। আর সর্বশেষ ১০ বছরে বেড়েছে পৌনে তিন গুণ। বছরের পর বছর ধরে সরকারের নীতিসহায়তা ও প্রণোদনা, সস্তা শ্রম আর উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের পোশাকশিল্প শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান, সহযোগী উপখাত আর কোটি কোটি ডলারের রফতানির কারণে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে পোশাকশিল্প। কিন্তু এ ব্যবসায়ে আসছে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জও। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। শুরু হয়েছে মূল্যযুদ্ধ।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রফতানিতে তৈরী পোশাক শিল্পের অবদান যতই বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অর্থনৈতিক ঝুঁকি। ভিয়েতনামের কাছে দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রফতানিকারকের মুকুট হারাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রফতানি ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে যাওয়ায় এই শঙ্কা আরো প্রবল হচ্ছে। এরই মধ্যে বছরের প্রথম ৯ মাসে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে ভিয়েতনাম। বিশেষ করে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে এক হাজার ৩৫ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। অন্য দিকে বাংলাদেশ রফতানি করেছে ৪৫৬ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি।
বিজিএমইএ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে নিট পোশাকের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কাপড় দেশে উৎপাদন হলেও ওভেন পোশাক তৈরির ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ কাপড়ই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। অন্য দিকে পোশাক তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় বোতাম, লেবেল, কার্টুনসহ অন্যান্য সরঞ্জামের প্রায় ৯০ শতাংশই দেশে উৎপাদন হচ্ছে। মূলত ওভেন কাপড় উৎপাদনে পিছিয়ে থাকার জন্যই মূল্য সংযোজন বাড়ছে না। এ জন্য বস্ত্র খাতে বিনিয়োগ দরকার বলে মনে করেন বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী। তার দাবি, অর্থনৈতিক অঞ্চলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জমি ও কিছু নীতিসহায়তা দিলেই বস্ত্রকলে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন উদ্যোক্তারা।
সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের সামনে সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। আমরা এখন নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতা করে পণ্যের দাম কমাচ্ছি। অনৈতিক প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে সবারই ক্ষতি করছি। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের পুরো অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে জানিয়ে তিনি বলেন, পোশাক খাত ৩০ লাখ নারীশ্রমিকের ক্ষমতায়ন করেছে। শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের সাথে যুক্ত ছোট ছোট দর্জি, মুদি দোকানি, ফ্ল্যাক্সি লোডের দোকানদার, লিপিস্টিক বিক্রেতা, লেইস ফিতার হকার থেকে শুরু করে অর্থনীতির অনেক খাতে প্রভাব পড়বে। আর আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর তো টিকে আছে পোশাক শিল্পের ওপরই। এ শিল্পের কিছু হলে আর্থিক খাতে চরম দুর্গতি নেমে আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।