Home Apparel পোশাক খাতে রোবট আনছে সম্ভাবনা, সঙ্গে শঙ্কাও

পোশাক খাতে রোবট আনছে সম্ভাবনা, সঙ্গে শঙ্কাও

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল কক্ষে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম তাপমাত্রায় দিনরাত সোয়েটার বোনায় ব্যস্ত ১২০টি নিটিং মেশিন। পাশেই কম্পিউটারে সোয়েটারের নকশা ও নির্দেশনা ঠিক করে দিচ্ছেন কিছু কর্মী। ওই নকশা ও নির্দেশনা মেনেই কাজ করে যাচ্ছে যন্ত্রগুলো।

সাভারে ঢাকা ইপিজেডের সফটেক্স সোয়েটার কারখানার চিত্র এটি। এক সময় যেখানে প্রতি পালায় অন্তত ৭০০ শ্রমিক কাজ করত কারখানাটির নিটিং বিভাগে, সেখানে এখন কাজ করে মাত্র ২২ জন। যন্ত্রে তৈরি সোয়েটারগুলো গোছানোই এখন তাদের মূল কাজ।

কারখানার হেড অব অপারেশনস তাহজীব উল গনি শাহজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন, এ কারখানায় কাপড় বোনায় আর শ্রমিকের হাত নেই।

“কম্পিউটারে তৈরি একটি সোয়েটারের নকশা ও পরিমাপ পেনড্রাইভে নিয়ে মেশিনে যুক্ত করে দিলেই হল। এখন একজন শ্রমিক একাই পাঁচটি মেশিন দেখভাল করতে পারেন। বুননের মূল কাজটি মেশিনই করে। মানুষ শুধু সেগুলো বুঝে নেয়।“

এই কারখানায় এখন জার্মানি ও চীনের তৈরি বিভিন্ন ধরনের ১৯২টি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে নিটিংয়ের কাজ হচ্ছে। আর এক সময় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক যৌথভাবে যা উৎপাদন করত এখন অর্ধেক শ্রমিক দিয়ে আধুনিক মেশিনে তার চেয়ে বেশি কাজ হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটির মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান আকিদুল ইসলাম মুকুল জানালেন, মেশিন চালানোর পাশাপাশি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বোঝেন এমন শ্রমিকদেরই তারা কাজে লাগাচ্ছেন। তবে নিটিং সেকশনের বাইরে উইন্ডিং, লিংকিং, ট্রিমিংসহ অন্যান্য বিভাগ আগের মতোই শ্রমিকের হাতে পরিচালিত হচ্ছে।

শুধু সফটেক্স সোয়েটারই নয়, বৈশ্বিক বাণিজ্যের বাস্তবতা আর প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে এভাবেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাক উৎপাদনের চিত্রটি বদলাতে শুরু করেছে। সহজভাবে বললে, শ্রমঘন এই খাতটি হয়ে উঠছে রোবটপ্রযুক্তি বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রনির্ভর।

এতে উৎপাদনশীলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের মান ভালো হচ্ছে, কমছে কারখানাগুলোর শ্রমিক নির্ভরতা। কমছে শ্রমিক অসন্তোষের ঝুঁকিও। তবে উল্টোদিকে প্রযুক্তিনির্ভরতার কারণে এই খাতের লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মহীন হয়ে পড়ার শঙ্কাও তৈরি হচ্ছে।    

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পে সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান। বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এই শিল্পে সরাসরি যুক্ত। 

যন্ত্রনির্ভরতার এই ‘ভালো-মন্দ’ দুটি চিত্রই পাওয়া যায় সফটেক্স সোয়েটারের কর্মকর্তা তাহজীবের কথায়।

তিনি জানান, তাদের কারখানায় আট বছর আগে আধুনিক প্রযুক্তি স্থাপনের ফলে উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে অন্তত পাঁচগুণ। কাজের মানও আগের চেয়ে নিখুঁত হয়েছে।

“এক সময় ছয়শ হাতেচালিত মেশিনে কারখানায় যে কাজ করা হত, সেখানে এখন মাত্র দুইশ মেশিনে চলছে একই পরিমাণ উৎপাদন। তবে হাতেচালিত নিটিং মেশিনের পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র স্থাপনের ফলে বেকার হয়েছে কিছু শ্রমিক।”

তবে কতগুলো কারখানা রোবটপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে এবং এর ফলে কত শ্রমিক কর্মহীন হয়েছে- এই মুহূর্তে তার কোনো পরিসংখ্যান জানা না গেলেও মালিক-শ্রমিক এবং খাত সংশ্লিষ্ট কেউই কিন্তু প্রযুক্তিবিরোধী নন।

বরং যান্ত্রিকীকরণের মধ্য দিয়ে সংকুচিত হয়ে আসা শ্রমবাজারের বিকল্প হিসেবে নতুন কোনো খাতকে টেনে তোলা এবং শ্রমিকদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

আগ্রহী হয়ে উঠছেন মালিকরা

বাংলাদেশে তুলনামূলক বড় পোশাক কারখানাগুলো রোবটপ্রযুক্তি স্থাপনে এগিয়ে আছে। গত তিন-চার বছর ধরে এই প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে।

পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক সফটেক্স সোয়েটারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজওয়ান সেলিম নিজেকে অটোমেশনে যুক্ত হওয়া প্রথম সারির একজন মনে করেন। পোশাকখাতের পালাবদলের এই যাত্রায় অন্যদেরকে উৎসাহও দেন তিনি।

“সফটেক্স সোয়েটার অটোমেশনের পক্ষে পাইওনিয়র। আমি অন্যদেরকেও এজন্য উৎসাহিত করি। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজারে টিকে থাকতে হলে অটোমেশনে যুক্ত না হয়ে উপায় নেই,” বলেন এই ব্যবসায়ী।

রেজওয়ান বলেন, “এখন থেকে চার বছর আগে আমি অটোমেশন শুরু করি। এখন আমার কারখানার ফ্লোরে শ্রমিক নেই বললেই চলে, অথচ দিনরাত উৎপদান চলছে। চার বছর আগে এই কারখানায় তিন হাজার ৬০০ শ্রমিক ছিল। এখন সেখানে মাত্র ১৪শ শ্রমিক দিয়েই সেই কাজ করে ফেলা যাচ্ছে। বরং কাজের মান, উৎপাদনশীলতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।”

রোবটপ্রযুক্তির পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, “কারখানায় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি স্থাপন একটি চলমান প্রক্রিয়া। মালিকরা একটু একটু করে এসব ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি স্থাপন করছেন। এতে অধিক শ্রমিক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়ছে।

“বর্তমানে সারা বিশ্বে পোশাকের দাম কমে যাচ্ছে, অর্ডার কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাচ্ছে। এসব কারণে রোবটপ্রযুক্তি স্থাপন ও এর সুফল ঘরে তোলা এখন সময়ের দাবি।”

বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোয় রোবটপ্রযুক্তি ব্যবহার এখনও ব্যাপক আকারে শুরু না হলেও এই পথে না হাঁটলে ভবিষ্যতে ঝুঁকিতে পড়তে হবে বলে মনে করেন চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন।

তিনি বলেন, “বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে পোশাকখাতে অটোমেশন এখনও ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। তবে একটু একটু করে মালিকরা এই দিকে হাঁটছে। অটোমেশনে আমরা মাঝারি পর্যায়ে আছি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, চীন, পাকিস্তান- এসব দেশ অটোমেশনে এগিয়ে গেছে।

“যে হারে শ্রমিকের বেতন বেড়েছে এবং বাজারে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তাতে সক্ষমতা ধরে রাখতে অটোমেশনে যেতেই হবে। এতে পণ্যের উপাদান যেমন বাড়ে, খরচও কমে আসে। অটোমেশন না হলে ভবিষ্যতে এই খাত টিকতে পারবে না।”

বিরোধী নন শ্রমিকরাও

বকেয়া বেতন-ভাতা, চাকরিচ্যুতি, বন্ধ কারখানা খোলাসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে পোশাক শ্রমিকদের প্রায়ই পথে নামতে হয়। কখনও কখনও পুলিশের সঙ্গে ঘটে যায় সংঘাত। শ্রমিক সংগঠনগুলোকেও বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায়।

কিন্তু অটোমেশনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ার বিষয়টি অনেকটা নীরবেই মেনে নিয়েছেন তারা। রোবটপ্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে পড়া নিয়ে খুব বেশি মতামত দেননা শ্রমিক নেতারাও। বাস্তবতাটা তারও মানছেন।

গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কার্যকরি সভাপতি কাজী রুহুল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও সময়ের প্রয়োজনে শিল্পখাতে, বিশেষ করে পোশাকখাতে রোবটপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এর ফলে কারখানাভিত্তিক অনেক শ্রমক্ষেত্র কমে আসছে, শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। বাস্তবতাকে যেভাবে মেনে নিতে হয়, বিষয়টি সেভাবেই সবাইকে মেনে নিতে হবে।”

তবে এর বিপরীত একটি চিত্র দেখিয়ে এই শ্রমিক নেতা বলেন, “উদ্বেগের বিষয়টি হল, যেসব কারখানা অটোমেশনে গেছে, সেখানে শ্রমিক অনেক কমে গেছে। যারা আছে, সেই শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

“আগে যেখানে আট ঘণ্টা কাজ করলেই চলত সেখানে এখন ১২ ঘণ্টা কাজ করানো হচ্ছে। তুলনামূলক পরিশ্রম কম হওয়ার কারণে অনেক সময় শ্রমিক সেটা মেনেও নিচ্ছে, এমনটি হওয়া উচিৎ নয়।”

কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ রেখে তিন শিফটে কাজ চালু রাখলে অটোমেশনের মধ্যেও কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

ঝুঁকি দেখছে আইএলও

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উন্নত প্রযুক্তি, রোবটপ্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে শ্রমিকদের কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা- আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর তোমো পুতেনিয়ান।

এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “অটোমেশনের ফলে বাংলাদেশে লাখ লাখ অদক্ষ শ্রমিকের কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন কর্মীদের কাজের ক্ষেত্রও বাড়বে। একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিশাল স্বল্পশিক্ষিত অদক্ষ শ্রমবাজার সত্যিই একটি ঝুঁকিতে রয়েছে।

“যদিও আইএলও মনুষ্য কায়িকশ্রম কমাতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে, একই সঙ্গে প্রযুক্তির কারণে মানুষের কর্মহীন হওয়ার বিষয়টি নিয়েও উদ্বেগ দেখায়। প্রযুক্তির চাহিদা পূরণে মনুষ্য নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তির ওপর গুরুত্ব দেয় আইএলও।”

দরকার পদ্ধতিগত পরিকল্পনা

বিজিএমইএ সভাপতি মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হকও অটোমেশনের পক্ষে। তবে তিনি অটোমেশনের কারণে চাকরি হারানো শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের কথাও বলেছেন।

“অটোমেশন এখন বাস্তবতা ও প্রয়োজন। তাই আমাদেরকে শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের চিন্তা শুরু করতে হবে। তাদের নতুন কর্মসংস্থানের চিন্তা করা সরকারের কাজেরও অংশ।

“সেটার জন্য একটি পদ্ধতিগত পরিকল্পনা নিতে হবে। পোশাকখাতের যারা শ্রমিক তাদেরকে এই মুহূর্তে প্রশিক্ষণ দিয়ে হয়তো প্রযুক্তিবিদ কিংবা এ ধরনের কিছু বানানো যাবেনা। কিন্তু তাদের জন্য উপযোগী কিছু অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে।”

বাংলাদেশের শ্রমিকদের হাতে তৈরি পোশাকপণ্যের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং বা বাজার সৃষ্টি করা গেলে তা অটোমেশনের ঘাটতি পূরণে কিছুটা ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।

“পশ্চিমা দেশগুলোতে বিভিন্ন হস্তশিল্প দেখা যায়, যেগুলোর বাজারমূল্য তুলনামূলক বেশি। সম্ভবত আমাদেরকেও এ ধরনের হাতে তৈরি পোশাকের দিকে নজর দেওয়া উচিত, যেখানে মূল্য সংযোজনের অধিকাংশটাই আসবে শ্রম থেকে। এছাড়া অন্যান্য বিকল্প বিভিন্ন চিন্তা আসা উচিত।”

শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন মনে করেন, অটোমেশনের কারণে শ্রমিকদের ওপর যে ধাক্কাটা আসবে, সেটা সামলাতে সরকারকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।

রুবানা হকের মতো তিনিও বেকার হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা বলেছেন।   

“কারখানায় অটোমেশনকে আমরা শ্রমস্বার্থের বিরোধী বলতে চাই না। এটি একটি পরিবর্তন মাত্র। জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির এমন উপস্থিত দেখা যায়। তবে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সরকারকে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি শ্রমিকদের মধ্যে নানামুখী যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রবেশ ঘটিয়ে তাদেরকে আধুনিক শ্রমবাজারের উপযোগী করতে হবে।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here