রানা প্লাজা ধসের পর বৈদ্যুতিক, অগ্নি ও ভবনের কাঠামোগত সংস্কারকাজ সম্পন্ন করেছে বা এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, এমন ধরনের বড় পোশাক কারখানাগুলোর মুনাফা বেড়েছে। সংস্কারকাজের আগে ২০১৩ সালে তাদের মুনাফা ছিল পোশাক রপ্তানির ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত বছর সেটি বেড়ে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়েছে। তার মানে, ৪ বছরের ব্যবধানে তাদের মুনাফা বেড়েছে দশমিক ৯২ শতাংশ।
বড়দের পাশাপাশি ছোটদের মুনাফা বেড়েছে। তবে মাঝারি আকারের কারখানাগুলোর মুনাফা কিছুটা কমে গেছে। ২০১৩ সালে মাঝারি কারখানার মুনাফা ছিল ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। গত বছর সেটি কমে ৮ দশমিক ২৬ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে ছোট কারখানার মুনাফা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ হয়েছে।
‘দেশের পোশাক খাতে কমপ্লায়েন্সের প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মনজুর হোসেন ও কাজী ইকবাল এবং গবেষক তাহরীন তাহরিমা চৌধুরী গবেষণাটি করেন।
মোট ৫০৮টি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার ওপর জরিপ চালিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স এবং জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) অধীনে রয়েছে, এমন ২৫৫টি এবং সংস্কারকাজের বাইরের তবে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য ২৫৩টি কারখানা রয়েছে। কারখানাগুলোর অর্ধেকই একক মালিকানাধীন। বাকিগুলোর মধ্যে যৌথ মালিকানার ২০ শতাংশ ও লিমিটেড কোম্পানি ২৬-২৮ শতাংশ পোশাক কারখানা।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক নিহত হন। আহত হন সহস্রাধিক শ্রমিক। এই ঘটনার পর বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। তাই কর্মপরিবেশ উন্নয়নে তখন ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স গঠিত হয়। উভয় জোটের অধীনে পরিদর্শনের মাধ্যমে ২ হাজারের বেশি পোশাক কারখানার বৈদ্যুতিক, অগ্নি ও ভবনের কাঠামোগত ত্রুটি খুঁজে বের করা হয়। তারপর সংশোধন কর্মপরিকল্পনা (ক্যাপ) অনুযায়ী কারখানাগুলো সংস্কারকাজ করে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের বাইরের কারখানাগুলোর একটি অংশে এনটিএপির অধীনে সংস্কারকাজ চলছে। অবশ্য এই তিন উদ্যোগের আওতার বাইরেও অনেক কারখানা রয়েছে।
৪
বছরের ব্যবধানে বড় কারখানাগুলোর মুনাফা বেড়েছে দশমিক ৯২ শতাংশ
আর মাঝারি কারখানার মুনাফা কিছুটা কমেছে
বিআইডিএসের গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সংস্কারকাজের বাইরে থাকা বড় কারখানারও মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৩ সালে তাদের মুনাফা ছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত বছর সেটি বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৭৪ শত ংশ। তবে সংস্কারকাজের বাইরে থাকা ছোট ও মাঝারি কারখানার মুনাফা বেশ কমেছে। গত বছর ছোট কারখানার মুনাফা ছিল ৫ শতাংশ, যা ২০১৩ সালে ছিল ৬ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে মাঝারি কারখানার মুনাফা একই সময়ে ১০ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৭ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমেছে।
জানতে চাইলে বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মনজুর হোসেন বলেন, মুনাফার তথ্যটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, জাতীয় শিল্পনীতি অনুসারে ১২০ জনের কম শ্রমিক কর্মরত থাকলে তা ছোট কারখানা, ৫০০ শ্রমিক থাকলে মাঝারি কারখানা এবং শ্রমিকসংখ্যা পাঁচ শতাধিক হলে তা বড় কারখানা হিসেবে বিবেচিত।
এই গবেষণা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামাল গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, গত ডিসেম্বরে শ্রমিকের মজুরি ৫১ শতাংশ বেড়েছে, জানুয়ারিতে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছে। এর ওপর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় দক্ষ কারখানাগুলোর ৩-৪ শতাংশ মুনাফা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে বিআইডিএসের গবেষণায় যে মুনাফার কথা বলা হয়েছে, তা বর্তমানে বাস্তবসম্মত নয়।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, সংস্কারকাজের মাধ্যমে কর্মপরিবেশের উন্নয়ন করলেও কারখানাগুলোর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়নি। তা ছাড়া নতুন ক্রেতা, বাজার ও বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদন বাড়েনি তাদের। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ক্রেতারাও কর্মপরিবেশ উন্নয়ন করা কারখানাগুলোর তৈরি পোশাকের দাম বাড়ায়নি। উল্টো ক্রেতারা নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানাতেও আগের মতো ক্রয়াদেশ দিয়ে যাচ্ছে।
বিষয়টি
নিয়ে মনজুর হোসেন বলেন, কারখানার
সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার পর খুব বেশি সময় অতিবাহিত হয়নি। ফলে স্বল্প সময়ে খুব বেশি ভালো ফলাফল আশা করাও যুক্তিযুক্ত নয়। তিনি আরও বলেন, ‘যেসব কারখানা বৈদ্যুতিক, অগ্নি ও কাঠামোগত ত্রুটি সংশোধন
করেছে,
সেসব প্রতিষ্ঠানের পোশাকশ্রমিকেরা আগের চেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করছেন। তবে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়নি।
আমরা মনে করি, বিধি অনুযায়ী নিম্নতম
মজুরি,
কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের সম্পর্কের মানোন্নয়ন ও যথাযথ প্রশিক্ষণ দিলে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।’
বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামাল আরও বলেন, সংস্কারকাজের পর কারখানাগুলোতে ক্রয়াদেশ বেড়েছে। তবে শিল্পটির সক্ষমতা যে হারে বেড়েছে, সেই হারে ক্রয়াদেশ বাড়েনি। এ ছাড়া ক্রেতারা পোশাকের দামও বাড়ায়নি।