দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি গার্মেন্টসশিল্প। বিপুলসংখ্যক মানুষ এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। সেই গার্মেন্টসশিল্পে দুর্দিন নেমে এসেছে। আয় বাড়াতে না পেরে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা। চাকরি হারাচ্ছেন শ্রমিক। ভালো ব্যবসার উদ্দেশে পোশাক মালিকদের ব্যাপকহারে ঋণ দিয়ে বিপদ বাড়ছে ব্যাংকগুলোর। ঋণ নিয়ে খেলাপির খাতায় নাম লিখিয়েছেন ২ হাজার ৬০৫ উদ্যোক্তা। ব্যাংকগুলোর আটকে গেছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে এ ঋণ মন্দমানের খেলাপি বা কুঋণ। চলতি বছরের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে গার্মেন্টস খাতে রপ্তানি।
গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে সংকট চলছে। এ সংকটের মূল কারণ বিদেশের বাজারে রপ্তানি কমে যাওয়া। কাক্সিক্ষতভাবে আয় করতে না পারায় শিল্পমালিকরা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। একাধিক ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই ভালোভাবে ব্যবসা করছেন। ব্যাংকের সঙ্গে তাদের লেনদেনও ঠিক আছে। কিছু বাস্তবিক সমস্যায় পড়লে ব্যাংক স্বেচ্ছায় তাদের সহায়তা করছে।
কিন্তু পোশাকশিল্পে কিছু দুর্বৃত্ত প্রবেশ করেছে। অভিজ্ঞতাহীন এসব ব্যক্তি কারখানা খুলে বসেছেন। এরাই বর্তমানে ব্যাংকের গলার কাঁটা। এমন গ্রাহকও পাওয়া গেছে, যারা ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন, রপ্তানির নামে নগদ সহায়তা নিয়েছেন জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে। রপ্তানি না করেই ভুয়া বিল তৈরি করা হয়েছে এবং নতুন কারখানার নামে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। খেলাপিদের বড় অংশই এমন জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত।
পোশাকশিল্পের সংকট সমাধানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য সংকট চিহ্নিত করতে ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ জানতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গার্মেন্টসে কী পরিমাণ ঋণ ও খেলাপি ঋণ আছে তার তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১ হাজার ৪৭ জন পোশাক ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তা ব্যাংকগুলো থেকে ১ লাখ ৭১ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে ২ হাজার ৬০৫ জন খেলাপি হয়ে গেছেন। তাদের কাছে আটকে আছে ১৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এ ঋণ মন্দমানের খেলাাপি, যা আদায়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ওই প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ১৪ হাজার ২৬৮ জন গার্মেন্টস মালিক ৯৩ হাজার ৪২২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। খেলাপি হয়েছেন ১ হাজার ৫৮০ জন। ব্যাংকের আটকে আছে ৮ হাজার ২০২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে টেক্সটাইল খাতে দেওয়া ৭৮ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৬ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। এ খাতের ৬ হাজার ৭৭৯ জন উদ্যোক্তা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন ১ হাজার ২৫ জন।
গার্মেন্টস খাতে বেশি কুঋণ রয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলোর। সবচেয়ে বেশি ৩ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা কুঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকের। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ৮৫৫ কোটি এবং অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামস উল-ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, গার্মেন্টস খাতে সংকট শুরু হয়েছে; কিন্তু এখনো গুরুতর নয়। ভিয়েতনাম আমাদের টপকে গেছে। গার্মেন্টসশিল্পের শুধু ব্যাংকের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করলে হবে না, এটি লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সঙ্গে জড়িত। তাই খেলাপি হলেও তাদের কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সে বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করছে ব্যাংকগুলো।
গার্মেন্টসশিল্প মালিকদের খেলাপি হওয়ার বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, আমাদের সংগঠনের ২৮ জন সদস্য খেলাপি হয়েছেন। তাদের কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা ৫ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। তাদের খেলাপি হয়ে যাওয়ার মূল কারণ সক্ষমতার অভাব। অনেকেই সঠিকভাবে ব্যবসা করতে পারছেন না। এই কারণে চলতি বছরের সাত মাসে বন্ধ হয়েছে ৫৯ কারখানা, যেখান থেকে প্রায় ২৯ হাজার ৭০০ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।
এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রপ্তানি আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৭ শতাংশ কম। এর মধ্যে টেক্সটাইল খাতে রপ্তানি কমেছে ১৩ শতাংশ এবং তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ।