দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের রপ্তানি খাত পোশাকনির্ভর। আর পোশাকশিল্প খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হওয়ায় পুরো রপ্তানি খাতে এর প্রভাব পড়েছে। এতে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য পিছিয়ে পড়ছে। তাতে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, যা পুরো দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম রপ্তানি হয়েছে। এই সময়ের রপ্তানি করার যে লক্ষ্যমাত্রা, তার চেয়ে ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম। অর্থবছরের প্রথম এই ছয় মাসে ১ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ আয় আসে পোশাকশিল্প রপ্তানি করে। তবে এ খাতে রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে চলতি বছরের প্রথম থেকেই রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে যাচ্ছে। আলোচ্য সময়ে নিটওয়্যার ও ওভেন গার্মেন্টস মিলিয়ে ১ হাজার ৬০২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ২১ শতাংশ কম। অবশ্য একক মাস হিসেবে ডিসেম্বরে আগের বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে সার্বিক রপ্তানি বেশি হয়েছে। আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ডিসেম্বরে ২ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি রপ্তানি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পোশাক খাতসহ হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি পণ্যের ওপরই নির্ভরশীল দেশের রপ্তানি বাণিজ্য। বাংলাদেশ থেকে সাত শতাধিক পণ্য রপ্তানি হয়। সংখ্যার দিক থেকে এটি বিশাল। তবে তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে হিমায়িত খাদ্য এবং পাট ও পাটজাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় কিছুটা বেশি থাকলেও অন্যান্য পণ্য থেকে রপ্তানি আয় খুবই কম। আর পণ্য রপ্তানির গন্তব্যও খুব অল্প। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো দেশেই মোট রপ্তানির ৮০ ভাগ রপ্তানি হয়, যা দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
শুধু পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভর না করে পণ্যে বৈচিত্র্যকরণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, একটি পণ্যের ওপর নির্ভরতা দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এ বিষয়ে তিনি ভেনিজুয়েলার পতনের গল্প শুনিয়েছিলেন। সেখানে তিনি একটি মাত্র পণ্য তেলনির্ভর দেশটি কীভাবে দুর্ভিক্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা বিশ্লেষণ করেন। অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকেরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছিলেন, যদি রপ্তানি বাণিজ্যের ধারায় পরিবর্তন না আনা যায়, তাহলে রপ্তানি বাণিজ্য টেকসই করা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। এখন দেশের রপ্তানি বাণিজ্য সেদিকেই যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
এক পণ্য বা গুটি কয়েক পণ্যনির্ভর হলে কী সমস্যা হতে পারে, তা বলতে গিয়ে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সীমিত পণ্য ও বাজার এবং প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় উত্পাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে টার্মস অব ট্রেড (এক ইউনিট রপ্তানির পরিবর্তে কত ইউনিট আমদানি করা যায়)। রপ্তানির ক্ষেত্রে এক পণ্যনির্ভরতা বা এক্সপোর্ট কনসেনট্রেশন থেকে বের হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সরকারি ও বেসরকারি কোনো উদ্যোগই তেমন কার্যকর হচ্ছে না।
এক্সপোর্ট কনসেনট্রেশন যেসব দেশে বেশি, তাদের টার্মস অব ট্রেড খুব কমে যায়। আর যেসব দেশ রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে পেরেছে, তাদের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। একই সঙ্গে তাদের টার্মস অব ট্রেডও স্থিতিশীল হয়েছে। রপ্তানির সঙ্গে প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। রপ্তানি ভালো হলে বিনিয়োগ বাড়ে, নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে রপ্তানি বহুমুখীকরণের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ হলে টার্মস অব ট্রেড স্থিতিশীল থাকার পাশাপাশি রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও বাড়ে।